কয়েক ছত্র
বাংলাদেশে সংবিধানের কী দরকার? কার জন্য দরকার? নাগরিকের জন্য, নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য? যে সংবিধানে দেশের একজন মানুষের জনগণ থেকে নাগরিক হওয়ার সুযোগ নেই, সেই সংবিধান দিয়ে আমরা কী করব? আমরা যখন জনগণ থেকে নাগরিক হতে যাই, তখন নাগরিক অধিকার সামনে আসে। সংবিধানে আমাদের নাগরিক অধিকার আদৌ আছে? উত্তর জানতে চাইলে সবাই আমরা বলব অবশ্যই আছে। কিন্তু আসলেই কি আছে? চলুন একটু খতিয়ে দেখি।
সংবিধানে ‘চিকিৎসা’ আমাদের মৌলিক অধিকারগুলোর একটা অন্যতম অধিকার। এখন একজন নাগরিক চিকিৎসা পেল না অথবা অপচিকিৎসা পেল অথবা চিকিৎসার অভাবে মারা গেল। সেই নাগরিক কি রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে? রাষ্ট্র বা সরকার কি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা পরিবারকে তার প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে পারবে? উত্তর হলো, না। তাহলে এই সংবিধান জনগণ বা নাগরিকদের কী কাজে লাগবে? যত দিন পর্যন্ত নাগরিক অধিকারে কোনো গ্যারান্টি ক্লজ থাকবে না, যত দিন পর্যন্ত সংবিধানে রাষ্ট্র বা সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত হবে না, তত দিন এই সংবিধান সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসবে না। এটা থাকা আর না-থাকা সমান কথা।
বিএনপি ও অন্য রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই সংবিধান সংস্কার করবে না। কারণ, এই সংবিধান মূলত তাদের রাজনীতির নামে অপরাজনীতি করার একমাত্র সনদ। তারা সবকিছুই করতে পারবে সংবিধানের দোহাই দিয়ে। একজন প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব ক্ষমতা এই সংবিধান দিয়েছে। রাষ্ট্রপতিকে রাখা হয়েছে মূলত ওপর নির্ভরশীল করে। এভাবেই সংবিধান ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছে। বলা যায়, বর্তমান সংবিধান ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রবিন্দু। এই সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী যত আকাম-বদকামই করুক, কোনোভাবেই তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী না চাইলে কোনো মন্ত্রী-এমপির বিচার করা যাবে না। আর তাই ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংস্কার বা সংশোধন চায় না। সংবিধান তাদের রাজনীতির একমাত্র রক্ষাকবচ। সংবিধান তাদের কমফোর্ট জোন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই সংবিধানের কোনো সম্পর্ক নেই।
রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে আওয়াজ তুলেছে টুকটাক সংস্কার করে যেন দ্রুত নির্বাচন দেওয়া হয়। ভোটে জিতে যে দল সরকার গঠন করবে, তারা নাকি সংবিধান সংস্কার করবে। এটা একটা তামাশার আলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রথমত, সরকার গঠনের পর সরকারের জন্য যা যা ভালো সেভাবেই সংবিধান পরিমার্জন বা সংশোধন হবে। এটাই বাস্তবতা। দ্বিতীয়ত, যারা সংবিধানের আলোকে দেশ পরিচালনা করবে, তারাই যদি সংবিধান সংস্কার করে, সেটা যেমন নির্মোহ নির্ভেজাল সংবিধান হবে না, তেমনি বৈধতাও পাবে না। সংবিধান সংস্কার হতে হবে সর্বস্তরের জনতার রায়ে।
বিএনপি তার ৩১ দফায় কিছু সংস্কারের আলাপ তুলছে। পরপর দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হবে। মোটা দাগে এই দুইটা সাংবিধানিক সংস্কার উল্লেখযোগ্য। এটা বিএনপির একটা রাজনৈতিক চাতুর্য। বিএনপি সত্যিই যদি যুগোপযোগী সংস্কার চায় এবং দেশকে সংবিধানের আলোকে এগিয়ে নিতে চায়, তাহলে বিএনপিকে বলতে হবে এ দেশে দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী বা এমপি হতে পারবেন না।
দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী বা এমপি হওয়ার সুযোগ যদি না থাকে তাহলে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যিনি প্রধানমন্ত্রী বা এমপি হবেন তিনি এমনভাবে দেশ চালাবেন যেন এটাই তাঁর জীবনের শেষ সুযোগ। এতে একদিকে যেমন দেশে অপরাজনীতি এবং দুর্নীতি দুটোই অনেকাংশে কমে যাবে, অন্যদিকে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তরুণেরা দেশ চালানোর সুযোগ পাবে। তরুণদের হাতে যখন দেশ চালানোর স্টিয়ারিং থাকবে, তখন দেশ থেকে ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, পাচার, কাজে স্থবিরতা, অবিচার, অপরাজনীতি অনেকাংশেই কমে যাবে। তরুণদের রক্ত এখনো পুরোপুরি দূষিত হয়ে যায়নি। তরুণদের প্রতিই আমাদের আস্থা, তরুণেরাই আমাদের শেষ ভরসা।
দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের চাওয়া, দেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটাভুটির মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার হোক। এমন একটা সংবিধান রচিত হোক, যাতে দল-মতনির্বিশেষে দেশের প্রত্যেক মানুষ যেন সুরক্ষা পায়। রাজনৈতিক সরকারগুলো জবাবদিহির আওতায় আসুক। নতুন সংবিধানের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো সেই সংবিধান সমুন্নত রাখুক। রাজনৈতিক সরকারগুলোর প্রয়োজনমতো সংবিধান কাটাছেঁড়া চিরতরে বন্ধ হোক।