হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার উপায়

মৃত্যুঞ্জয় রায় 

মানিকগঞ্জের ঘিওরের কাউটিয়া গ্রামে প্রাকৃতিকভাবে চাষ করা বিন্নি ধান। ছবি: লেখক

আহা কী আনন্দের দিনগুলোই না ছিল। হেমন্ত এলেই বাড়ি বাড়ি নবান্নের ধুম পড়ে যেত। নতুন ধানের নতুন চাল, চালের গুঁড়ির শিন্নি আর পিঠা—সারা পাড়া যেন মেতে উঠত উৎসবে! সে আনন্দ উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নতুন ধান। মাঠে মাঠে কত রকমের ধান যে ফলত! একেকজন কৃষক একেক রকমের ধান চাষ করতেন একেক কাজের জন্য। বাড়িতে বড় কুটুম আসবে, তাই তাঁকে রেঁধে খাওয়াতে হবে চামারা চালের ভাত। টাঙ্গাইলে একসময় চামারা ধান নিয়ে একটা প্রবচনের চল ছিল—আত্মীয়র মধ্যে মামারা, ধানের মধ্যে চামারা। আজ সে ধানও আর খুঁজে পাওয়া যায় না, বাংলার সেসব লোকসংস্কৃতিও উধাও হয়েছে। আজও ছোটবেলায় ঠোঁটের আগায় লেগে থাকত কবি জসীমউদ্‌দীনের কবিতার কিছু পঙ্‌ক্তি—‘আমার বাড়ি যাইও ভোমর,/বসতে দেব পিঁড়ে,/জলপান যে করতে দেব/শালি ধানের চিড়ে।/শালি ধানের চিড়ে দেব,/বিন্নি ধানের খই,/বাড়ির গাছের কবরী কলা,/গামছা বাঁধা দই।’ সে কালের আমন্ত্রণ আর অতিথি আপ্যায়নে বিন্নি ধানের খই ও শালি ধানের চিড়া—দইয়ের সঙ্গে যা ছিল অমৃতের মতন। শালি কথাটা শাইল ধানের সহজ রূপ, যা আমন মৌসুমে হয়, শ্রাবণে চারা লাগানো হয় ও অগ্রহায়ণে পাকে। চারা যখনই লাগানো হোক, সেসব জাতের ধান পাকত অগ্রহায়ণে—সেটাই ছিল প্রকৃতির নিয়ম।

পয়লা অগ্রহায়ণের পড়ন্ত বেলায় রহিম, রবিন, আনিস ও আমি—আমরা চার প্রকৃতিবন্ধু হাজির হলাম মানিকগঞ্জে ঘিওরের কাউটিয়া গ্রামে প্রাণবৈচিত্র্য খামারে। খামারে সকালে আয়োজন করা হয়েছিল নবান্ন উৎসবের। সেদিনই ধান কেটে মলাই করে চাল বের করে সে চালের গুঁড়ি দিয়ে বানানো হয়েছে নবান্নের পিঠা ও পায়েস। খামারের পাশের মাঠগুলোয় ধান কাটা প্রায় শেষ। ধানশূন্য মাঠগুলোকে দেখে জীবনানন্দের কবিতার মতো মনে হচ্ছে—‘যে মাঠে ফসল নাই চাঁদ এসে তাহার শিয়রে/দাঁড়ায়েছে, চাঁদ তুমি আসিয়াছ কাহাদের তরে/বাসমতী-সন্তানেরা চলে গেছে ঘরে।’ পশ্চিমের আকাশটা লালচে হতে শুরু করেছে, দূরে মাঠের প্রান্তে ধীরে ধীরে নামছে হালকা কুয়াশা, সন্ধ্যার আকাশে ক্ষয়ে যাওয়া পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে। সেই শূন্য মাঠে তখনো শির নত করে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে লালচে-সোনালি ধানের শিষ। ধানগুলো দেখিয়ে প্রাণবৈচিত্র্য খামারের প্রাণ দেলোয়ার জাহান বললেন, এটা বিন্নি ধান, নেত্রকোনার বিন্নি ধান। নেত্রকোনায় সোমেশ্বরী নদীর পাড়ে ও মেঘালয় পাহাড়ের কোলে গারো ও হাজং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা এই বিন্নি ধানের চাষ করে। চাল আঠাল ও সুগন্ধি। পানি দিয়ে এ চাল রাঁধা মুশকিল, কাই হয়ে যায় ভাত। তাই এর ভাত রাঁধা হয় পানির বাষ্প দিয়ে। খেতে সুস্বাদু। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা তাদের বিভিন্ন পরবে এ চালের পায়েস ও পিঠা রেঁধে খায়। তবে আমরা বিন্নি ধানের যে খইয়ের কথা শুনি, তার জাত আলাদা, এ বিন্নির খই হয় না। এর গাছ প্রায় সাড়ে ৪ ফুট লম্বা হয়, পাকতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে চার মাস, চাল মাঝারি মোটা। মাত্র চার শতক জমিতে তিনি এ জাতের ধান চাষ করেছেন মূলত বীজের জন্য। বীজ হলে তা প্রাকৃতিক কৃষক সমাজের মধ্যে বিতরণ করবেন, যাতে এ জাত হারিয়ে না যায়।

শুধু বিন্নি ধান না, সে মাঠে তিনি চাষ করেছেন চামারা, ঢেপো, বড় ভাওয়াইল্যা, ছোট ভাওয়াইল্যা, দীঘা, লক্ষ্মীদিঘা, দেশি চিনিগুঁড়া, রাজভোগ, বরণ ইত্যাদি ষোল দেশি জাতের ধান। বলেন, এসব জাতের ধান চাষে খরচ তেমন নেই, যত্নও তেমন লাগে না। বরং এরা বিরূপ আবহাওয়াতেও টিকে থাকতে পারে, খুব গরম পড়লেও ধান চিটা হয় না, রোগ-পোকা লাগে না বললেই চলে। আধুনিক জাতের তুলনায় ফলন একটু কম হলেও স্বাদ ও স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এ জাত অনন্য। চাষ থেকে মাড়াই পর্যন্ত এসব জাতের ধানের জন্য কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা যায় না, কম্বাইন হার্ভেস্টর দিয়ে ধান কাটাও যায় না। তাই এসব দেশি জাত পরিবেশবান্ধব। যন্ত্র চালনা মানেই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, তার মানে পরিবেশের ক্ষতি। জলবায়ু পরিবর্তনের নানা অভিঘাত সহ্য করে দেশি জাতগুলো টিকে থাকতে পারে, যা বেশির ভাগ আধুনিক ও হাইব্রিড জাত পারে না। পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ এসব জাতে নেই বললেই চলে। কোনো বালাইনাশক ও আগাছানাশক ব্যবহার করতে হয় না। এতে মাটি, পানি, বাতাস—প্রকৃতির এসব উপাদান দূষিত হয় না, অন্য জীবদের ক্ষতি হয় না। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, আগে এ এলাকায় মধুশাইল নামে একটি দেশি জাতের ধান চাষ করা হতো। একবার চারা লাগানোর পর সে ধানের চারা মাসখানেক বানের পানিতে ডুবে ছিল। বানের পানি সরে যাওয়ার পর দেখা গেল কোনো কোনো গাছের একটা বা দুটো পাতা বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে। কিন্তু কয়েক দিন পরই পুরো মাঠ সবুজ হয়ে উঠল। কী আশ্চর্য তার পরিবেশের প্রতিকূলতা সইবার ক্ষমতা! বোঝা গেল, প্রাকৃতিক চাষের এসব লোকজ্ঞান কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি ব্রত গ্রহণ করেছেন, খামারে খুলেছেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

সে যুগে আমন ধানের মৌসুমটাই ছিল সারা বছরের খোরাক তোলার মৌসুম। এ সময় ওঠা ধানে কৃষকদের সারা বছরের খাদ্যের সংস্থান হতো। এ জন্য আরবি শব্দ ‘আমানত’ থেকে এসেছে ‘আমন’ শব্দটি, যার অর্থ নিরাপত্তা। আমন ধানই ছিল সেকালে খাদ্যের নিরাপত্তা ও মূল ভরসা। অতীতে এ মৌসুমে হাজার হাজার জাতের ধানের চাষ হতো একেবারেই প্রাকৃতিক নিয়মে। কোনো সার নেই, সেচ নেই, পোকা মারা বিষের বালাই নেই। ধান থেকে চাল বের করা হতো কাঠের ঢেঁকিতে। তাই সেসব চালের ওপর থাকত একটা পাতলা লালচে পর্দা, যা ছিল পুষ্টির ডিনামাইট। এখন স্বয়ংক্রিয় কল এসেছে, চাষের জন্য যন্ত্র ও সার-বালাইনাশক এসেছে, আর আধুনিক ও হাইব্রিড জাতের দাপটে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এ দেশ থেকে প্রায় দশ-বারো হাজার জাতের ধান। হারানো সেসব জাতরত্ন আর ফিরবে না। জেনেটিকসের বিশেষজ্ঞরাই ভালো বুঝতে পারেন যে আধুনিক হতে গিয়ে প্রকৃতির কী অমূল্য সম্পদ আজ আমরা হারিয়ে ফেলেছি! এর মধ্যেও দেলোয়ার জাহানের মতো একজন প্রাকৃতিক কৃষক আবার সেসব প্রকৃতির জাতরত্নকে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস নিয়েছেন, এর চেয়ে আনন্দের বার্তা আর কী হতে পারে? প্রাকৃতিক চাষাবাদ চলে প্রকৃতির নিয়মেই। এ নিয়ম যত বেশি আমরা মানতে পারব, তত বেশি আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ ভালো থাকবে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে, আমরাও ভালো থাকব। এ দেশের প্রকৃতি, জীবন ও লোক ঐতিহ্য রক্ষায় আজ যা খুবই দরকার।

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’

টানাপোড়েনের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচন

বার্ধক্য শুরু হয় পা দিয়ে

নো ওয়ান কিলড তিন্নি!

শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই

ভ্যাট বৃদ্ধি ও জনজীবনে চাপ

মানুষ কী চায়

শিশুকে কোন স্কুলে ভর্তি করাবেন

বুমেরাং

অর্থ আত্মসাৎকারীদের শাস্তি হোক কঠিন

সেকশন