হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

শিশুকে কোন স্কুলে ভর্তি করাবেন

শ্যামল আতিক

আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭: ৪০
সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর আগে দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নেবেন। ছবি: আজকের পত্রিকা

নতুন বছর এসেছে। শিশুকে কোথায় ভর্তি করিয়েছেন? স্কুলে নাকি মাদ্রাসায়? ইংরেজি মাধ্যম নাকি বাংলা মাধ্যমে? সরকারি নাকি বেসরকারি স্কুলে? অনেকে এখনো ভর্তি করাননি। শিশুকে প্রাইমারিতে পড়াবেন নাকি কিন্ডারগার্টেনে? স্বাভাবিক স্কুলে দেবেন নাকি বিশেষ শিশুদের স্কুলে? এসব নিয়ে প্রায় সব মা-বাবার চিন্তার অন্ত নেই।

আশপাশ থেকে আসে অসংখ্য পরামর্শ। এত পরামর্শের ভিড়ে অধিকাংশ মা-বাবাই বুঝতে পারেন না কোথায় ভর্তি করাবেন। বেশির ভাগ সময় অন্যের অনুকরণে বা চাপে পড়ে বা বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে শিশুকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়। অথচ শিশুর বর্তমান সুবিধা-অসুবিধা এবং ভবিষ্যতে কী বাস্তবতা মোকাবিলা করতে হতে পারে, এই বিষয়গুলো একেবারেই আমলে নেওয়া হয় না।

সবাই নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোঁজেন। কিন্তু সেখানে পড়াশোনা হয় কি না, সেদিকে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমাদের দেশে এমন অনেক নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে আদতে কোনো পড়াশোনা হয় না। অভিভাবকেরা নিজ উদ্যোগে সন্তানদের প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়িয়ে ভালো রেজাল্ট অর্জনের চেষ্টা করেন।

পড়াশোনা হয় না জেনেও কেন অভিভাবকেরা এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাচ্ছেন? অনেকের কাছে ভালো কোনো বিকল্প নেই। তবে বেশির ভাগই ভর্তি করাচ্ছেন সামাজিক স্ট্যাটাস বা আভিজাত্য রক্ষার জন্য, যেন সবাইকে বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন—আমার ছেলে/মেয়ে অমুক নামকরা স্কুলে পড়ে। ভাবখানা এমন যে এসব স্কুলে ভর্তি করাতে না পারলে সমাজে তাঁরা মুখ দেখাতে পারবেন না।

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তির কারণ খুঁজলেও দেখতে পাবেন এই সামাজিক স্ট্যাটাস রক্ষার লড়াই। তবে তা সবার ক্ষেত্রে নয়। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি মনে করেন, আপনার সন্তান ভবিষ্যতে দেশের বাইরে পড়াশোনা এবং বসবাস করবে, তাহলে আপনার জন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নির্বাচন করাই সঠিক। কিন্তু শিশুকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়িয়ে, আপনার ভবিষ্যৎ চাওয়া যদি হয় সন্তান দেশে থাকবে, তাহলে ভবিষ্যৎ কিছু চ্যালেঞ্জের জন্য আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

আপনার আর্থিক সামর্থ্য কম হলে, যেখানে পড়াশোনার খরচ বেশি সেখানে ভর্তি না করানোই ভালো। যদি ভর্তি করান, তাহলে আপনি দুই দিক দিয়ে চ্যালেঞ্জে পড়বেন। প্রথমত, প্রতি মাসের স্কুলের খরচ বহন করতে গিয়ে আপনাকে হিমশিম খেতে হবে। পাশাপাশি নানা কারণে বিব্রতও হবেন। অভিভাবক যদি ভালো ইংরেজি বলতে না পারেন অথবা আর্থিকভাবে কম সামর্থ্যবান হন, তাহলে কর্তৃপক্ষও আপনার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাবে। দ্বিতীয়ত, উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আপনার শিশুও তাদের লাইফস্টাইল অনুকরণ করার চেষ্টা করতে পারে। অথবা নিজেকে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারে। ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘পিয়ার প্রেশার’। সবাই গাড়িতে করে স্কুলে আসে, দামি স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপ আছে, অথচ আমার নেই—এ ধরনের ভাবনা তাকে সব সময় পীড়া দেবে। দিন শেষে শিশুর হীনম্মন্যতাজনিত প্রতিক্রিয়া আপনাকেই সামলাতে হবে।

ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারা। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। কারণ, এত দিন তারা যে ধরনের পরীক্ষা পদ্ধতিতে অভ্যস্ত ছিল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি সে তুলনায় ভিন্ন। বাধ্য হয়েই একটি বড় অংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, অথবা অন্য বন্ধুদের দেখাদেখি সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় দেশের বাইরে পাড়ি জমায়।

অনেক মা-বাবা শিশুকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়েও ধর্মীয় শিক্ষা দিতে চান। এ জন্য তাঁরা এমন স্কুল নির্বাচন করেন যেখানে দুটোই আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ ধরনের স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষার প্রাধান্য থাকলেও একাডেমিক কারিকুলাম মূলত পশ্চিমা ধারার। উন্নত বিশ্বের সিনেমা, ভাষা, গান, পোশাক, খাবার-দাবার, সংস্কৃতি ইত্যাদির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে একসময় শিক্ষার্থীরা নিজের পরিচয়কেই ভুলে যেতে বসে। খুব কম শিশুই পারে পশ্চিমা সংস্কৃতির বিপরীতে ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধারণ করতে। অনেক অভিভাবক তাঁদের শিশুকে প্রাইমারিতে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে তারপরে বাংলা মিডিয়ামে আনতে চান। তাঁদের উদ্দেশ্য থাকে শিশুর ইংরেজির গাঁথুনি সুন্দর করা। তবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রপ্ত করতে ব্যর্থ হলে নতুন বাংলা মাধ্যম স্কুলেও শিশু নিজেকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।

আমি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিরুদ্ধে না। আমার বক্তব্য খুব সহজ—কেন আপনি শিশুকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দিচ্ছেন, তা আপনার কাছে পরিষ্কার থাকতে হবে। আপনি যদি মনে করেন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে আপনার সন্তানকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন, আপনার সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। শুধু অনুরোধ থাকবে, এমন স্কুল নির্বাচন করবেন যেখানে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির ওপর জোর দেওয়া হয়।

একই কথা মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে মাদ্রাসায় পড়িয়ে সন্তানকে যদি ভালো ডাক্তার বা বিজ্ঞানী বা গবেষক বা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে চান, তাহলে অবশ্যই কোন ধরনের মাদ্রাসায় ভর্তি করাচ্ছেন, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। এমন মাদ্রাসা নির্বাচন করতে হবে, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি গণিত, বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

আবার বাংলা মিডিয়ামে ভর্তির ব্যাপারে একই যুক্তি প্রযোজ্য। সেখানে পড়াশোনার মান কেমন? ইংরেজি ভাষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয় কি না? ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষ কতটা আন্তরিক—এই বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

শিশুকে যেখানেই ভর্তি করান না কেন, কিছু সাধারণ বিষয় অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে—ক্লাসরুমের পরিবেশ কেমন, শিক্ষকদের আচরণ কেমন, ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কি না, স্কুলে কোন শ্রেণি-পেশার পরিবারের শিশুরা পড়ছে, পর্যাপ্ত খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে কি না, বইয়ের বোঝা বা পড়াশোনার চাপ কেমন, পরীক্ষার নামে শিশুদের ওপর মানসিক পীড়ন দেওয়া হয় কি না, শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করা হয় কি না, ছাত্র-শিক্ষকদের অনুপাত, স্কুলের বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচ কেমন? যে স্কুলে শিশুকে ভর্তি করাতে চান, সেখানে একদিন গিয়ে দেখে আসুন।

সবকিছু আপনার মনমতো হবে, ব্যাপারটি তা নয়। তারপরেও দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নেবেন। বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব, আপনার আর্থিক অবস্থা, স্কুলের সার্বিক পরিবেশ ইত্যাদি সব বিষয় মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিশু স্পেশাল চাইল্ড হলে বিশেষ স্কুলে ভর্তি করানোই ভালো। তাদের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের প্রয়োজন হয়। তবে শারীরিক পঙ্গুত্ব থাকার পরেও শিশু যদি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী না হয়, তাহলে সাধারণ স্কুলে ভর্তি করাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে একজন শিশু মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নিলে ভালো হয়। তবে এই শিশুদের প্রতি স্কুল কর্তৃপক্ষ বিশেষ নজর দিতে পারবে কি না, এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। আবার আপনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হলে শিশুকে এমন স্কুলে দেবেন না, যেখানে সে বিব্রত হতে পারে।

শ্যামল আতিক, প্যারেন্টিং বিষয়ক গবেষক

মানুষ কী চায়

বুমেরাং

অর্থ আত্মসাৎকারীদের শাস্তি হোক কঠিন

সেকশন