হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

ফেসবুক রণক্ষেত্র নয়, রক্ষাকর্তাও নয়

বিধান রিবেরু

মুখপুস্তক বা ফেসবুক আমাদের জনগোষ্ঠীর মনের অবস্থা বোঝার ক্ষুদ্র জানালা হলেও অগুরুত্বপূর্ণ নয়। ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার-এক্স বা থ্রেডস নয়, এ দেশের আমজনতার কাছে জনপ্রিয় হলো ফেসবুক। তারা এর ভেতর দিয়ে নিজেকে অবিরত প্রকাশ করে, আবার খবরাখবরও সংগ্রহ করে, অর্থাৎ তথ্য আদান-প্রদান করে। এই তথ্য ভুল কি সঠিক, সেই বিবেচনা আমাদের ব্যবহারকারীদের কম। তারা সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে ঠিকই, কিন্তু সর্বোচ্চ বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহার করছে না তথ্য গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে। যে কারণে ফেসবুকে মিথ্যা খবর প্রচার করে বেশ ফল পাওয়া যায়। গুজব, বানোয়াট তথ্য, সাম্প্রদায়িক উসকানি, রাজনৈতিক মতাদর্শ দিয়ে অন্যকে ঘায়েল করা, কুৎসা রটান, ঘৃণা ছড়ান, এমনকি অর্ধসত্যকে সম্পূর্ণ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কাজটাও সংঘটিত হয় ফেসবুকে। এটা প্রযুক্তির সমস্যা নয়, প্রযুক্তি যে ব্যবহার করছে, তার সংকট। সভ্যতার সংকট।

অনেক সময় দেখা যায় সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ গুটিকয়েক ব্যবহারকারীর জন্য এমন দিকে চলে যায়, যাতে ওই আলাপটি মূল বিষয় থেকে সরে যায় অনেক দূরে। জটিল বিষয়কে আবার অনেকে এতটা সরল করে উপস্থাপন করেন, যাতে বিষয়টি জনসাধারণের কাছে উপস্থাপিত হয় ভুলভাবে। যেহেতু অধিকাংশ ব্যবহারকারী বিষয় সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে পোস্ট দেন না, বেশির ভাগ সময়ই অন্যদের পোস্ট পড়ে অথবা ঘটনার উপরিভাগ দেখেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান এবং নিজের অবস্থান নির্ধারণ করে ফেলেন, তাই মূল ঘটনা ও তার বোঝাপড়ার ভেতর বিস্তর ফারাক তৈরি হয়। আর এটাই বাজে প্রভাব ফেলে অন্যদের ওপর।

সম্প্রতি বাংলাদেশে যে ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে, জুলাই অভ্যুত্থানের পূর্বাপর দেখে মনে হচ্ছে কয়েক হাজার সাইবার যোদ্ধা অক্লান্ত কাজ করে চলেছে ফেসবুকে। এদের ভেতর মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পোস্ট তৈরি করার প্রবণতা যেমন আছে, তেমনি আছে বিভিন্ন ধরনের মিম তৈরি করে প্রতিপক্ষকে হেয়প্রতিপন্ন করা বা ঘায়েল করার মিশন। এসব নানামুখী অ্যাজেন্ডার ভিড়ে সাধারণ ব্যবহারকারীরা ওসব মিশনের অংশ হয়ে পড়েন। তাঁরাও প্রপাগান্ডা খেলায় শামিল হয়ে যান নিজের অজান্তেই। অবশ্য পুরোটাই যে অজান্তে হন, তা-ও নয়, তাঁদেরও রাজনৈতিক অবস্থান থাকে। যাঁরা প্রপাগান্ডার অংশ হন তাঁদের ভেতর একাংশ আবার স্রেফ ‘মজা নেওয়া’র উদ্দেশ্যে নানাবিধ পোস্ট শেয়ার ও রিপোস্ট করেন। এটা অবশ্য তাঁদের অচেতন মনেরই পরিচয় বহন করে।

তো ফেসবুক এখন এমন এক জায়গায় চলে গেছে যে বিয়ের পাত্র-পাত্রী বলি কিংবা চাকরিপ্রত্যাশী—সবার ক্ষেত্রেই চরিত্র সনদ দিয়ে থাকে ফেসবুকের টাইমলাইন। ঠিক এই কারণেই আবার অনেকে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। তাঁরা চান না তাঁদের অন্দরমহলের খবর অন্য কেউ পড়ে ফেলুক। প্রশ্ন হলো, তাহলে লোকজন ফেসবুকে পোস্ট দেন কেন? দেন কারণ তাঁরা চান তাঁদের কথা কেউ না কেউ শুনুক। শুধু শুনবে না, কেউ না কেউ তাঁর মতামতকে সমর্থন দিক। বাহবা দিক।

একজন যখন ফেসবুকে পোস্ট দেন, তখন তাঁর মনের ভেতর বাসনা থাকে তাঁর আদর্শে বিশ্বাসী কারও সঙ্গে তিনি যুক্ত হবেন। এবং তাঁর মতামত যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা শোনার ভেতর দিয়ে তাঁর চিন্তার অনুমোদন আদায় হবে। অনেকে নিজের নাম উজ্জ্বল করার নিমিত্তেও পোস্ট দেন, অনেকে আবার লাইক-শেয়ার-কমেন্টের লোভ সামলাতে না পেরে যা-তা পোস্ট দিতে থাকেন রাতদিন।

পত্রিকায় দেখেছি ‘ডাটা রিপোর্টালে’র জরিপ অনুযায়ী ২০২৪ সালের শুরুতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা গোটা জনগোষ্ঠীর ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। সংখ্যাটি কিন্তু অনেক বড়। এত মানুষ যেহেতু এটি ব্যবহার করে, তাই না চাইলেও এর গুরুত্ব বেড়ে যায় কয়েক শ গুণ। এইসব ব্যবহারকারীর ভেতর কতজন শিক্ষিত, তা নিয়ে স্বতন্ত্র জরিপ হতে পারে। তবে ফেসবুকের মাধ্যমে যে ধরনের পোস্ট ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের ভিডিও কনটেন্ট বা রিলস তৈরি হয়, সেগুলোর অধিকাংশই নিম্ন রুচির পরিচয় বহন করে।

ফেসবুকে যে কেবল নেতিবাচক ঘটনাই ঘটে, তা নয়। কেউ কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করে গণতান্ত্রিক চর্চার পথকে প্রশস্ত করেন। কেউ সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ মত তুলে ধরেন। গঠনমূলক পোস্ট দেন। সেগুলো যদিও সংখ্যায় কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোনো ঘটনা ঘটলে বায়বীয় ঢাল-তলোয়ার নিয়ে নেমে যায় একদল মানুষ, তারপর তারা দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে নানা ধরনের কুতর্কের দোকান খুলে বসে।

ইদানীং একদল ব্যবহারকারী সৃষ্টি হয়েছে, যারা পরমাণুবিজ্ঞান থেকে মহাকাশবিজ্ঞান, রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, কবিতা থেকে চলচ্চিত্র—সর্ব বিষয়ে পারদর্শী। কোন বিষয়ে তার কথা বলা সাজে, কোন বিষয়ে সাজে না বা কোন ব্যাপারে কথা বলা অনুচিত, এসব ঔচিত্যবোধ তাদের ভেতর কাজ করে না। যেন ফেসবুক মানেই হলো হরেদরে সব বিষয়ে নিজের মত জাহির করার উৎকৃষ্ট স্থান। এখন হোক সেই মত যৌক্তিক বা অযৌক্তিক কিংবা উৎকট।

আপনার দ্বিমত থাকতে পারে। তৃতীয় মতও থাকবে। সবার সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছানো যাবে না। কারও পোস্টের মন্তব্যে সেই ভিন্নমত প্রকাশেও প্রয়োজন ভদ্রতা ও বিনয়। অনেকেই দেখবেন অযাচিতভাবে আক্রমণ করে বসেন। এতে বোঝা যায় ফেসবুক ব্যবহারের রীতি সম্পর্কে তিনি অবগত নন। বলতে পারেন ব্লক করার অপশন তো রয়েছে। সেটা তো রইলই শেষ হাতিয়ার হিসেবে, কিন্তু মানুষ সভ্য আচরণ করবে না কেন? ফেসবুকে যে মানুষটি অন্যের বিরুদ্ধে চরম বাজে কথা বলছে, অন্যের পোস্টে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করছে, সেই লোকটিই কিন্তু সভ্য দুনিয়ার সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, ফেসবুক ‘চালাচ্ছে’, সে কেমন করে এমন অসভ্য আচরণ করে? আমার ধারণা, আমরা সার্বিকভাবে গণতন্ত্রচর্চা থেকে সরে গিয়েছি বলেই অন্যের মত বা পথের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে পারি না। সঠিক যুক্তিও উপস্থাপন করতে পারি না, ব্যক্তি আক্রমণ করে বসি। সবচেয়ে বড় কথা ‘চুপ’ থাকতে পারি না। অনেক সময় চুপ থাকাটাও তো প্রতিবাদ! বাচালের মতো সব জায়গায় বকবক করতে হবে কেন? তবে হ্যাঁ, অনেক সময় পুরোনো কথাও মানুষকে বারবার বলতে হয়, যদি সেই যৌক্তিক কথা ধীরে ধীরে দাবিতে রূপ নেয়, তাহলে সেটা আন্দোলিত করতে পারে কোটি হৃদয়। সে ক্ষেত্রে আপনার পোস্ট হয়ে উঠতে পারে সার্থক প্রচেষ্টা।

অন্যায়ের প্রতিবাদ করে পোস্ট দিলে কারও না কারও বিরুদ্ধে যাবে, এটা ঠিক। এসব ক্ষেত্রে আপনাকে সাহস সঞ্চয় করে লিখে উঠতে হবে। অনেক উদাহরণ রয়েছে, ফেসবুকে লেখালেখির কারণেই সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই মাধ্যমটির ক্ষমতা তো রয়েছে, এ কারণে এর অপব্যবহারও কম নয়। অহরহই দেখবেন ফেসবুকে তাই ফাঁদ পাতা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী ফাঁদ। প্রতিহিংসার ফাঁদ। তাই চট করে কিছু বিশ্বাস করে পোস্ট দিয়ে বসা অনুচিত। এমনিতেই বাস্তব জীবনে মানুষ প্রচণ্ড চাপে থাকে, তাকে আর চাপে ফেলার দরকার নেই। আমি জানি, ফেসবুকে ক্ষোভ ঝেড়ে মানুষ হয় তো শান্তি পেতে চায়, কিন্তু এটা শান্তি প্রাপ্তির সঠিক পথ নয়। বরং উল্টো, স্ক্রিন টাইম কমিয়ে, ফেসবুকে সময় কম ব্যয় করে যদি বই পড়া যায়, যদি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যায়, সেটাই বরং আপনার মানসিক স্বাস্থ্যকে ভালো রাখবে। ভার্চুয়াল দুনিয়ার এই ফেসবুক দিয়ে মন শান্ত করা যাবে না। মনে রাখা ভালো, ফেসবুক রণক্ষেত্র নয়, রক্ষাকর্তাও নয়। এখানে জান ও প্রাণ ক্ষয় করার মানে নেই। একান্ত যদি ফেসবুক ব্যবহার করতেই হয় তাহলে এমন পোস্ট দেওয়া উচিত, যাতে অন্য অস্থির হৃদয় সেটা দেখে কিছুটা সুস্থির হয়। সৃজনশীল ও চিন্তাশীল বিষয় উপস্থাপনের ভেতর দিয়ে যদি ফেসবুক ব্যবহার করা যায়, তাতে আমি মনে করি সব দিকই রক্ষা পায়। আমার মতে সংকটের একটাই নিদান, মুখপুস্তকের বদলে মুখের সামনে পুস্তক ধরে পড়তে শুরু করা। তাহলেই মনের জানালা আরও অবারিত হবে। মন বড় হলে আমরা অপরের প্রতি সহিষ্ণু ও শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠব।

লেখক: বিধান রিবেরু

প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক

‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’

টানাপোড়েনের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচন

বার্ধক্য শুরু হয় পা দিয়ে

নো ওয়ান কিলড তিন্নি!

শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই

ভ্যাট বৃদ্ধি ও জনজীবনে চাপ

মানুষ কী চায়

শিশুকে কোন স্কুলে ভর্তি করাবেন

বুমেরাং

অর্থ আত্মসাৎকারীদের শাস্তি হোক কঠিন

সেকশন