হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

ফিরিয়ে দিন শহীদ আনোয়ারা উদ্যান

মৃত্যুঞ্জয় রায় 

আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ১১
শহীদ আনোয়ারা পার্কের জায়গায় প্লাজা তৈরির প্রতিবাদে পরিবেশবাদীদের সমাবেশ। ছবি: আজকের পত্রিকা

নব্বইয়ের দশক থেকে দীর্ঘদিন ঢাকা শহরের মণিপুরিপাড়ায় ছিলাম। তখন সেখান থেকে রাস্তা পার হয়ে শহীদ আনোয়ারা উদ্যানের ভেতর দিয়ে ইন্দিরা রোডের দোকানগুলোতে কেনাকাটা করতে যেতাম। দুটি প্রধান রাস্তার মাঝে একটি আয়তাকার ছোট পরিসরে গড়ে তোলা হয়েছিল সেই উদ্যান। উদ্যানে ছিল নাগেশ্বর, বকুল, চাঁপা, চামেলি, বেলি, অশ্বত্থ, কদম, পাকুড়, খইয়া বাবলা, মেহগনি, রঙ্গন, গন্ধরাজ, শিউলি, সোনালু, ছাতিম, ইউক্যালিপটাস, রয়্যাল পাম ইত্যাদি গাছ।

একদিন দেখলাম রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে, উদ্যানের গাছগুলো কাটা হচ্ছে। কী হবে ওখানে? জানলাম মেট্রো স্টেশন হবে। কী আনন্দ! মণিপুরিপাড়া থেকে আর রাস্তার জ্যাম ঠেলে বাসে চেপে মতিঝিল যেতে হবে না। সে আনন্দ মাথায় করে মাঝে মাঝে মণিপুরিপাড়ার বাসার ছাদে উঠে মেট্রোরেল সড়কের কাজ দেখতাম আর স্বপ্ন বুনতাম। তত দিনে মেট্রোরেলের উড়াল সড়কের নিচে গাড়ি চলাচল আর সরঞ্জামাদিতে উদ্যানটি শেষ হয়ে গেছে। ওখানে মেট্রোরেলের অফিস, ভান্ডার ও শ্রমিকদের থাকার ঘর করা হয়েছে। ভেবেছিলাম মেট্রোরেল চালু হলে আবার হয়তো সেই শহীদ আনোয়ারা উদ্যানকে ফিরে পাব।

এখন সেখানে থাকি না। কিন্তু প্রায় রোজই মেট্রোরেলে চেপে শাহবাগ থেকে ফার্মগেট যাই আর তাকিয়ে দেখি সে উদ্যানের উলঙ্গ রূপ। অফিসঘরগুলো সরে গেছে, পূর্ব দিকে এখনো কিছু গুদামঘর ও গাড়ি, বেড়া ইত্যাদি রয়ে গেছে। মাঝখানে ফাঁকা মাঠ পড়ে আছে। শোনা গেছে, শহীদ আনোয়ারা পার্কের জায়গায় পার্ক না করে প্লাজা তৈরি করা হবে। এর প্রতিবাদে পরিবেশবাদীরা প্রতিবাদ সমাবেশও করেছিলেন। কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও তাতে নগর কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। হলে মেট্রো স্টেশন পুরো চালু হওয়ার পরও সেখানে উদ্যান তৈরির কোনো আলামত দেখা যায়নি। জানি না সেই ধ্বংস করা উদ্যানটি আর কখনো ফিরে আসবে কি না।

উন্নয়নের জন্যই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের কোনো ক্ষতি না করার বিধান রয়েছে। এমনকি প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের কোনো ক্ষতি করা যাবে না। অথচ শহীদ আনোয়ারা উদ্যান শুধু একটি উদ্যান না, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস।

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় ২৫ জানুয়ারি ঢাকার নাখালপাড়ার বাসায় চার মাসের শিশুসন্তান নার্গিসকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন মা আনোয়ারা বেগম। এমন সময় পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনীর বুলেট টিনের বেড়া ভেদ করে আনোয়ারা বেগমের গায়ে বিদ্ধ হয় এবং তিনি নিহত হন। এ ঘটনায় তাঁর স্মরণে এই মাঠটিতে আনোয়ারা উদ্যান নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়। পরে এটা ‘শহীদ আনোয়ারা উদ্যান’ নামে পরিচিতি পায়। দুই বছরের বেশি সময় উদ্যানটি মেট্রোরেলের নির্মাণসামগ্রী রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কথা ছিল, মেট্রোরেলের কাজ শেষ হলে উদ্যানটি আগের রূপে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তা না করে উদ্যানে একটি প্লাজা তৈরি করার পরিকল্পনা করছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। এটা জনসাধারণ ও ঢাকার জন্য কল্যাণকর হবে না। ফার্মগেটে শহীদ আনোয়ারা উদ্যানের এ জায়গাটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের, এটির রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দায়িত্ব ছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)। এসব কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, শহীদ আনোয়ারা উদ্যানটিকে আগের চেয়েও সুন্দর করে জনসাধারণের কাছে ফিরিয়ে দিন। রুক্ষ ফার্মগেটে এই সামান্য সবুজটুকু টিকে থাক, বেঁচে থাক আমাদের সবুজ ভালোবাসা।

গ্রামে কোনো উদ্যান বা পার্ক নেই, উদ্যান আছে নগরে। এ দেশের প্রায় ৪৬ ভাগ (প্রায় ৫ কোটি ২০ লাখ) মানুষ শহরে বাস করে। অথচ এ বিপুল জনগোষ্ঠী সুপরিবেশে বসবাসের জন্য যতটুক সবুজের অংশ থাকা দরকার, তা শহরে নেই। শহরে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, কলকারখানা থাকাটাই স্বাভাবিক—শহর তো আর বনের জায়গা না। সব ধরনের দূষণ শহরেই বেশি, অথচ সেসব দূষণ কমানোর জন্য নেই গাছপালা ও ভালো কোনো ব্যবস্থা। রাস্তায় বেরোলেই মুখের ওপর ভসভস করে পুরোনো বাসের কালো ধোঁয়া এসে পড়ে, শব্দদূষণে কান ঝালাপালা হয়, রাস্তার পাশে থাকা জঞ্জালগুলো চোখে পীড়া দেয়, যত্রতত্র ফেলা আবর্জনা ও বর্জ্য থেকে দুর্গন্ধ আসে, ফুটপাতে দোকানপাট। এ রকম শত রকমের মন খারাপ করা নিয়ে শহরে রোজ আমাদের পথ চলতে হয়। তাই ভোরবেলা বা সন্ধ্যাবেলা—যখনই হোক নগরবাসীর অনেকেই একটু স্বস্তির জায়গা খুঁজে বেড়ান নগর উদ্যান বা খোলা মাঠে। কিন্তু সেখানে গিয়েও যদি সবুজের মায়াবিহীন নীল বিষাদ এসে ঘিরে ধরে তো কেমন লাগে? যাঁরা রোজ পার্কে যান তাঁরা নিশ্চয়ই বিরক্তিকর কিছু বিষয়ের মুখোমুখি হন সেখানে। ধানমন্ডি লেকের পাড়ের উদ্যানে গেলে মনে হয়, সেটা যেন উদ্যান না, ফুডকোর্ট। আবার সে উদ্যানের মধ্যেই এই শীতে ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য পাকা কোর্ট বানানো হয়েছে। উদ্যানগুলো কি খেলাধুলা আর খাওয়ার জায়গা? শহীদ আনোয়ারা উদ্যানের মধ্যেও ক্রিকেট খেলা হতো। চন্দ্রিমা উদ্যানের মধ্যে চলে স্কেটিং, সাইক্লিং ও শারীরিক কসরত।

নগরে উদ্যান করার একটা বড় উদ্দেশ্য হলো নগরবাসীর একটু সবুজের সান্নিধ্যে রাখা, বিনোদন দেওয়া, নগরের পরিবেশকে ভালো রাখা। যে নগরে যত বেশি সবুজ অংশ থাকে, সে নগর ততটাই পরিবেশবান্ধব শ্যামল নগরী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। একসময় আমাদের মহানগর ঢাকাও শ্যামল নগর ছিল। সে সময়ের পুরান ঢাকায় গাছপালা কম থাকলেও ছিল নীল জলের নদী, খাল, জলাশয়। বুড়িগঙ্গার সে নদীর জল এখন কালো হয়ে গেছে, নৌকায় নদী পার হতে গেলে নাকে রুমাল চাপতে হয় পচা দুর্গন্ধে। অতীতে বুড়িগঙ্গার তীরে থাকা গাছগুলোর শ্যামল ছায়া আর নদী থেকে উঠে আসা শীতল বাতাসে প্রাণ জুড়াত। ঢাকা শহরের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার পাড় ধরে ছিল সবুজের সমারোহ। বর্তমানে রমনা গ্রিনের সবুজটুকু ছাড়া এমন নিরেট সবুজ এ শহরে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ঢাকার বাইরে এখনো রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, সিলেট, চট্টগ্রাম নগর ঢাকার তুলনায় অনেক বেশি সবুজ। ঢাকায় দেশের অন্য যেকোনো শহরের চেয়ে বেশি পার্ক বা উদ্যান রয়েছে। দুই সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে উদ্যান রয়েছে ২৩টি ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে রয়েছে ২৮টি। এসব পার্কের অনেকগুলোই বেদখল বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক অংশ জব্দ করা গাড়ি রাখার ভাগাড়, গাছপালাও অবিন্যস্ত শ্রীহীন, হাঁটাচলাও শতভাগ নিরাপদ নয়। সদরঘাটের বাহাদুর শাহ পার্কের চেহারাও মলিন, জনসাধারণের হাঁটাচলা ও বসার স্থান সংকুচিত। কর্তৃপক্ষের উচিত দেশের সবগুলো পার্কের শ্রীবৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও ঐতিহ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করে সেগুলো জনগণের কাছেই ফিরিয়ে দেওয়া। আমরা বিদেশের পার্কগুলোর ছবি দেখলে অন্তত বুঝতে পারব যে আমাদের পার্কগুলো কতটা অপরিকল্পিত, শ্রীহীন ও পদে পদে কতটা অব্যবস্থাপনা এবং কী কী ঘাটতি রয়েছে। যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে শহীদ আনোয়ারা উদ্যানকে ফিরিয়ে দিন, অন্য পার্কগুলোকেও শ্রীময়ী করা হোক।

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

‘জনপ্রশাসন’ শব্দটাই একটা বিতর্কিত শব্দ

‘দারিদ্র্য নিরসন’ কথাটায় তিনি বিশ্বাস করতেন না

উচ্চমূল্যেও গ্যাস পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে কি