বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তিনি তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায়ই ছিলেন। অন্য সব সহকর্মীকে আত্মগোপনে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের পরামর্শ দিলেও তিনি নিজে আত্মগোপনে যাননি।
তিনি বরাবর নিয়মতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তা ছাড়া, সত্তরের নির্বাচনে তিনি পাকিস্তানের সরকার গঠনের গণরায় পেয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন সরকার গঠনের ন্যায্য দাবিদার। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী তাঁর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ২৫ মার্চ রাতে নিষ্ঠুর গণহত্যা শুরু করলে তিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
পয়লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। নির্বাচনের পর থেকে ইয়াহিয়া খানের টালবাহানা দেখে এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা শাসকগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় দেবে না। শক্ত হয়েই সেটা আদায় করে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুও সেটা বুঝতে পারছিলেন। একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য তাঁর ওপর চাপও ছিল। কিন্তু তিনি হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিয়ে উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। বিচ্ছিন্নতাবাদীর অপবাদ মাথায় নিতে চাননি। তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তাঁর প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থনের প্রকাশ ঘটিয়ে শাসকগোষ্ঠীকে আলোচনার সুযোগ দিয়ে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দিলে স্বাধীনতা ছাড়া যে সংকট সমাধানের পথ নেই—সেটা বুঝতে কারও কষ্ট হচ্ছিল না।
স্বাধীনতা ঘোষণার আইনি ও বৈধ এখতিয়ার তাঁরই ছিল। জনগণের নেতা হিসেবে পালিয়ে যাওয়াকে তিনি সঠিক মনে করেননি। তিনি আত্মগোপন করলে তাঁকে ধরার জন্য পাকিস্তানিরা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে বলেও তিনি আশঙ্কা করেছিলেন। অন্যদিকে, জেল-জুলুম সহ্য করলেও পালিয়ে রাজনীতি করা তাঁর পছন্দও ছিল না। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন: পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি না। কারণ আমি গোপন রাজনীতি পছন্দ করি না। আর বিশ্বাসও করি না।
২৫ মার্চ রাতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে তাঁকে জেলে বন্দী রাখা হয়। তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’ ঘোষণা করে গোপন বিচারও শুরু করেছিল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর মুক্তি ও নিরাপত্তার দাবি সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতসহ আরও অনেক দেশ প্রকাশ্যে এবং গোপনে করতে থাকায় শেষ পর্যন্ত বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে তাঁকে হত্যার নির্বুদ্ধিতা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দেখায়নি। বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও আত্মিকভাবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ দিনগুলোতে। তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। মুজিবনগর সরকারের তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। পাকিস্তানেও শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ৯ মাসের নিষ্ঠুর গণহত্যা এবং বর্বর অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তান ধিক্কৃত হয়। স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিও দেশের ভেতরে-বাইরে প্রবল হয়। ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীর কথাও পাকিস্তানকে বিবেচনায় নিতে হয়। নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন। তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য সেদিন ঢাকা শহরে জনতার ঢল নেমেছিল। বিমানবন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল লোকে লোকারণ্য।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত বিশাল জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেখানে যে ভাষণ দেন সেটা আসলে ছিল স্বাধীন দেশ কোন পথে পরিচালিত হবে, তার একটি রূপরেখা।
আবেগময় কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই, আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি। বোধ হয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।’
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসেছিলেন। দেশের মানুষ তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে স্বস্তি পেয়েছিল। সে দিনটি ছিল সে সময়কার বাংলাদেশের জন্য উজ্জ্বলতম দিন।