হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

সম্পর্ক হতে হয় দ্বিপক্ষীয়

আব্দুর রাজ্জাক 

ছবি: সংগৃহীত

সম্পর্ক তৈরি হয় পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে। এই বোঝাপড়া হতে হয় একে অন্যকে বুঝতে পারা, নিজের সমস্যাকে অন্যে যেন অনুভব করতে পারে বা বুঝতে পারে, আবার অপরের সমস্যাও আমি যেন হৃদয়ঙ্গম করতে পারি, এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে সম্পর্ক তৈরি হয়। এটা যেমন ব্যক্তিজীবনে, তেমন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও একই ব্যাপার।

ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটু লক্ষ করলে দেখা যায়, যার সঙ্গে যার মনের মিল আছে, একই রকম আচার-আচরণ, চালচলন পছন্দ করেন, তাঁদের মধ্যেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ব্যক্তিজীবনে বন্ধু ছাড়া জীবন যাপন করা প্রায় অসম্ভব। একটা কথা প্রচলিত আছে, যার জীবনে একজন প্রকৃত বন্ধু আছে, সেই মানুষই সুখী মানুষ।

সেই রকম রাষ্ট্রীয় জীবনেও এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের পারস্পরিক বোঝাপড়ার সহযোগিতা ও সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। এখন আসি প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে। আমাদের সমাজে এটা প্রায়ই ঘটে থাকে, প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকে না। একটা কথা যে প্রচলিত আছে, প্রতিবেশীর ছেলে হয়েছে, অপর প্রতিবেশী বলছে এই ছেলের লেখাপড়া হবে না, লেখাপড়া হলেও ভালো রেজাল্ট করতে পারবে না, ভালো রেজাল্ট করতে পারলেও চাকরি পাবে না। এ রকম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রায়ই অম্লমধুর হয়, অনেক সময় তিক্ত হতে থাকে। যদি উভয় দেশ নিজের কিছু স্বার্থ বিসর্জন না দিয়ে, শুধু একপক্ষীয়ভাবে সবকিছু পেতে চায়, সেখানেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে, এটা দেখতে পারেন বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে।

রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের অন্যতম কারণ হলো, শুধু একপক্ষ অন্যপক্ষকে সহ্য করতে না পারা। রাশিয়ার অভিযোগ হলো, ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেন রাশিয়ান প্রায় ১৪০০ মানুষকে হত্যা করেছে। এটা শুধু রাশিয়ান ভাষায় কথা বলার জন্য বা রাশিয়ান বংশোদ্ভূত হওয়ার জন্য হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেন বলেছে, এসব ছিল আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। রাশিয়া পরাশক্তি হয়ে আমাদের ওপর নাক গলাচ্ছে। তিন বছর ধরে চলমান যুদ্ধে উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার। তারপরও বাগ্‌যুদ্ধ থামছে না, শান্তি স্থাপনের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধ যে কবে শেষ হবে, তা বলাটা প্রায় অনিশ্চিত ব্যাপার। তবে শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে দুই পক্ষের যা অর্জন, তার চেয়ে ক্ষতি হয়েছে কয়েক শ গুণ বেশি।

শাতিল আরব নিয়ে ইরান ও ইরাকের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে বিশ্ববাসী দেখল দুই দেশেরই ক্ষতি হয়েছে সম্পদ ও জনবল। লাভ হয়নি কারও।

ইরাক-কুয়েত যুদ্ধেও একই ফলাফল বয়ে এনেছে।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্প্রতি বাগ্‌যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে ওপরের কথাগুলোর অবতারণা করলাম। পানি বণ্টন নিয়ে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে একটা দর-কষাকষি চলছে। কিছুদিন যাবৎ বাগ্‌যুদ্ধ রূপ নিয়েছে বাণিজ্যযুদ্ধে। এখন শুধু বাকি বন্দুকযুদ্ধ। পৃথিবীর শান্তিকামী কোনো মানুষই যুদ্ধ চায় না। প্রথমেই উল্লেখ করেছি, যুদ্ধে উভয় পক্ষ হারে, যুদ্ধে কেউ কখনো জিততে পারে না। আমরাও উভয় দেশের শান্তিকামী মানুষ চাইব, যুদ্ধের তৃতীয় পর্যায়ে যেন দুই দেশ না জড়ায়। শোনা যাচ্ছে, সীমান্তে ভারত প্রচুর সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করছে। বাগ্‌ ও বাণিজ্যযুদ্ধ চলতে চলতে কখন যে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, সেটা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।

একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে ‘কথায় কথা বাড়ে, ঘিয়ে বাড়ে বল, অমাবস্যার সময় পুবাল বাতাসে বাড়ে নদী-সমুদ্রের জল’। কেউ কথা যত বাড়াবে ততই বাড়বে। এই কথা বাড়াবাড়ি বুঝেশুনে বন্ধ করতে হবে এখনই। কথা চালাচালির একপর্যায়ে ভারত প্রথমে ভিসা বন্ধ করে দিল, বাংলাদেশের মানুষ ভালো চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে পারল না। আমার জানা মতে, বহু ক্যানসার রোগী, যাদের ইচ্ছা ছিল ভারতে চিকিৎসা করাবে, তারা দেশে সাধারণ চিকিৎসা করাচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভালো চিকিৎসা পাচ্ছে না। তারপর আরও কথা চালাচালি হলো, একে অপরকে মারাত্মক কথার আঘাত করা হলো। ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করে দিল। এই ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধের কারণে আমাদের গার্মেন্টস খাতে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার।

এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আমরা সুতা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছি। এতে ভারতের সুতা বিক্রি করতে হয়তো একটু কষ্ট হবে, কিন্তু আমাদের সুতার দাম বেড়ে যাবে শতকরা কুড়ি ভাগ। এতে উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হব। এখন ভারত যদি আবার আমাদের নির্মাণশিল্পের প্রধান উপকরণ পাথর রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, নির্মাণশিল্প সাংঘাতিক রকম বাধাগ্রস্ত হবে, তারপরে কয়লা বন্ধ করে দিলে ইট পোড়ানো কষ্টসাধ্য হবে, ইটের দাম অনেক বেড়ে যাবে। এ রকম চাল, পেঁয়াজসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিলে, আমরা মুশকিলে পড়ব, ভারতেরও অনেক লোকসান হবে।

কোনো কিছুর বিনিময়েই প্রতিবেশী বদল করা যায় না। ভারত আমাদের তিন দিকে ঘিরে থাকবে, এটা চিরন্তন সত্য, আবার ভারতের যে সেভেন সিস্টার্স আমরা পূর্বদেশ দিয়ে ঘিরে রেখেছি, এটাও সত্য। ভারত সমস্যায় আছে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে, লাদাখ ও তিব্বত সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে। ভারতের সমস্যা আছে অনেক প্রতিবেশীর সঙ্গে। এখন ভারত যদি সেভেন সিস্টার্স নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন করে সমস্যায় জড়ায়, তাহলে বিষয়টি তাদের জন্য সুখকর না-ও হতে পারে।

ভারত একটি বৃহৎ শক্তির দেশ। তারা আমাদের তিন দিক দিয়ে ঘেরা। তাদের সামরিক শক্তি অনেক গুণ বেশি আমাদের চেয়ে। শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্যপণ্যসহ অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। তাই এখানে আবেগ দিয়ে আমরা উল্লিখিত পণ্যগুলো আমদানির ক্ষেত্রে বিকল্প চিন্তাভাবনা করলে, আমাদের রিজার্ভ প্রতিবছর পাঁচ বিলিয়ন ডলার কমে যাবে। ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানি করি, সেই সব পণ্য অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হলে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বেশি মূল্যে কিনতে হবে। আবার ভারতের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের দেশে যেসব পণ্য সহজে রপ্তানি করে, এসব পণ্য অন্য দেশে রপ্তানি করতে সহজে পারবে না।

আবার আমাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অবনতির একটা কারণ হলো ধর্ম। দুই দেশের বেশির ভাগ মানুষ ভিন্ন দুই ধর্মে বিশ্বাসী। এই ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারটা নিজেদের মনের মধ্যে রেখে, বাস্তবতার ভিত্তিতে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের দেশের কিছু মানুষ আছে তারা প্রায়ই হুংকার দেয়, তলোয়ার নিয়ে ভারত দখল করে নেবে। আবার ভারতেও কিছু কিছু মানুষ আছে প্রায় কাছাকাছি হুংকার দেয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় এই আধুনিক যুগে তলোয়ার নিয়ে কোনো দেশ দখল করা যায় না, ঢাল-টেঁটা-লেজা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ও হুংকার দিয়ে যুদ্ধ হয় না। এখন যুদ্ধ হয় স্যাটেলাইটে। পেশিশক্তির পরিবর্তে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার হয়, হাজার মাইল দূর থেকে।

তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক উভয় পক্ষের। আমরা কেউই শক্তি প্রদর্শন করব না, দুই দেশেরই শান্তিতে বসবাসের জন্য যা করার দরকার, উভয় দেশের নেতারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেই পদক্ষেপ নেবেন বলে আমরা শান্তিকামী মানুষ আশা করছি।

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি