না, আমি সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তৈরি করা কোনো সূচকের কথা বলছি না। কিংবা বলছি না কোনো অর্থনীতিবিদের সুনির্দিষ্ট হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে তৈরি কোনো সূচকের কথাও। আমি বলছি, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণ যে সূচকগুলো নিজেদের চোখে, নিজেদের মতো হিসাব-নিকাশ করে দেখছে, সেগুলোর কথা। সেই সূচকগুলোর কোনোটিতেই ইতিবাচক প্রবণতা নেই। দেখা যাচ্ছে না ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো স্বচ্ছ চিত্রও। ফলে একধরনের আশঙ্কা অথবা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা অনিশ্চয়তাবোধ জনগণের মধ্যে কাজ করছে।
জনতার চোখে যে সূচকগুলো অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তার শীর্ষে রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য। এই ক্ষেত্রে মোটেই কোনো ইতিবাচক প্রবণতা নেই। চাল-ডাল ছাড়াও আলু-পেঁয়াজের দাম নিয়ে কাটাছেঁড়া অনেক হয়েছে। কিন্তু আমদানি বহুমুখী করা এবং ব্যাপক হারে শুল্কছাড়ের পরও এ ক্ষেত্রে ফলাফল শূন্য। বরং দাম আরও বেড়েছে। এরপর অতিসম্প্রতি সয়াবিন তেল নিয়ে যে তেলেসমাতি কাণ্ড জনগণ দেখল, তাতে আক্কেলগুড়ুম হওয়ারই কথা। কারণ, একই রকম কাণ্ড তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও একাধিকবার দেখেছে। প্রথমে কোনো সামগ্রীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা, তারপর বেশি দাম দিলে পাওয়া যাওয়া এবং শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেওয়া।
এবার অবশ্য এর পরেও সয়াবিন তেল সহজলভ্য হবে কি না সন্দেহ আছে। কারণ সরকার ঠিক করেছে তেল কিনবে এস আলম গ্রুপের কাছ থেকে। আগের হিসাবে সরকারের এই সিদ্ধান্ত ঠিকই ছিল। কেননা, এস আলম গ্রুপই ‘লার্জ বাল্ক’ আকারে তেল আমদানি করত। দেশের অন্য অনেক কোম্পানিও তাদের কাছ থেকে তেল কিনেই বাজারজাত করত। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এস আলম গ্রুপ আর আমদানি করছে না বলে তাদের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। সুতরাং শেষ পর্যন্ত সয়াবিন তেলের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এস আলম গ্রুপ তেল সরবরাহ স্বাভাবিক করার পরিবর্তে সরকারের কাছ থেকে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে ছাড়ও দাবি করতে পারে, যা অতীতে তারা করেছে। সয়াবিন তেলের পরিস্থিতি দেখে জনমনে এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে আসন্ন রমজান মাসে অনেক পণ্যেরই সংকট হতে পারে। এই আশঙ্কার আরও একটি কারণ বিভিন্ন পণ্যের আমদানিস্বল্পতা।
দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। সেখানেও সুবাতাস বইছে না। নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। অথচ দেশে চার-পাঁচ মাস ধরে রেমিট্যান্স আসছে আগের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি হারে। এর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে বৈদেশিক সহযোগিতার ব্যবস্থাগুলো করে এলেন, তার কথা। তখন শোনা গিয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টা একেকজন বিশ্বনেতার সঙ্গে বৈঠকে একেকটি প্রয়োজনীয় বিষয় উল্লেখ করার সঙ্গে সঙ্গে সেই বৈঠক থেকেই নির্দেশনা চলে গেছে সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষের কাছে। তারপর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বিশ্বব্যাংকের সভায় যোগদান শেষে বললেন, বিশ্বব্যাংক বলেছে বাংলাদেশ শুধু বলুক তাদের কী লাগবে!
কিন্তু জনতার চোখ এগুলোর কোনো ফলাফল অর্থনীতিতে দেখতে পাচ্ছে না। উপরন্তু বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক ঋণ ছাড়ের হার কমে গেছে। যেটুকু ছাড় হচ্ছে তারও বেশির ভাগ চলে যাচ্ছে আগের ঋণ ও তার সুদ পরিশোধে। ফলে নিট ঋণছাড় যেমন কমে গেছে, তেমনি ঋণের সুদের হার বেড়েছে। গ্রেস পিরিয়ড (ঋণ নেওয়ার পর পরিশোধ শুরু করার আগের সময়) কমে গেছে। তবে সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের হার মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিএনআই) ২২ শতাংশ। এই হার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তাহলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এতটা নড়বড়ে কেন? সেটা কি তাহলে ব্যবস্থাপনার সমস্যা?
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের আসনে বসে আহসান এইচ মনসুর অনেকবার বলেছেন, যতই তারল্যসংকট থাকুক না কেন, টাকা ছাপিয়ে কোনো ব্যাংককে অর্থ সরবরাহ করা হবে না। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও শেষ পর্যন্ত তিনি তা করলেন। আইএমএফ এই পদক্ষেপকে বলেছে ‘গণবিরোধী ও আত্মঘাতী’। তাহলে কেন এমন পদক্ষেপ? নিশ্চয়ই দায় ঠেকে। তাহলে এ ক্ষেত্রেও অবস্থা ইতিবাচক কিছু নয়।
আগের সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের লুটপাট একটি বহুকথিত ও আলোচিত বিষয়। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিশেষ আইন বাতিল করা ছাড়া এখন পর্যন্ত একটি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পর্যন্ত বাতিলের প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান একজন দক্ষ আমলা ছিলেন। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, তাঁকে তাঁর ছায়ার সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। ছায়া মানে আমলাতন্ত্র। তিনি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালেই রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করা শুরু হয়। আমার ধারণা, অন্তর্বর্তী সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকলেও এক মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিদ্যুতের সরবরাহ সংকট দেখা দেওয়াও অসম্ভব নয়। কোনো চুক্তি বাতিলের বিষয়ও অনিশ্চিত। এ বিষয়ে সর্বশেষ একটি কথা বলেছেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ জ্বালানি সমৃদ্ধি-২০৫০’ শীর্ষক এক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে চুক্তি বাতিলের কথাটা বলা যত সহজ, করাটা অত সহজ নয়।’ এই সূচকেও জনআকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন সবচেয়ে বিতর্কিত একটি বিষয়। প্রথম থেকে সরকার বলে এসেছে, যাঁদের ওপর নির্যাতন হয়েছে বা হচ্ছে তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগার। সেই হিসেবে তাঁরা নির্যাতিত। সংখ্যালঘু হিসেবে নয়। কিন্তু যে এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন আওয়ামী লীগার, তাঁর পরিবার নির্যাতিত হয়েছে। সেই এলাকায় তো সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের আওয়ামী লীগারও ছিলেন বা আছেন। দেখা গেছে সেখানে তাঁরা কেউ নির্যাতিত হননি। এটাকে কী বলা যায়? যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সফর শেষে প্রধান
উপদেষ্টার দপ্তর থেকে (তাঁর প্রেস সচিব) বলা হয়েছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতনের ৭০টি ঘটনায় ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে যে এই স্বীকারোক্তি করতে হলো, এর মধ্যেও ইতিবাচক কিছু নেই। কারণ বিষয়টি লুকানোর বা উপেক্ষা করার প্রবণতা ছিল।
এরপর আর বাকি থাকে রাজনীতি। সেখানেও জনতার চোখে যে প্রবণতা প্রতিফলিত, তাতে সবকিছু পুরোনো ধারায়ই চলেছে। রাজনীতির গতি-প্রকৃতিতে কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। ‘জো জিতা ভোহি সিকান্দার’ অর্থাৎ যে জিতেছে সেই রাজা। সে-ই সব পাবের সংস্কৃতি আর হিংসাত্মক রাজনীতি চলমান। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক অভিপ্রায় অত্যন্ত প্রবল হলেও কোনো দল নিজের মত ছাড়া অন্য কারও, অন্য কোনো দলের মতামতকে মান্যতা দিতে রাজি নয়। রাজনৈতিক মেরুকরণ এতটাই শক্তিশালী এবং বিস্তৃত যে তাকে ছাপিয়ে নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা খুব কঠিন। তবে জনতা এখনো এই আশায় আছে যে সাংবিধানিক সংস্কার এই পরিস্থিতি বদলে দেবে। তবে রাজনৈতিক বংশপরম্পরা বদলের বিষয়টি হয়তো অনিশ্চিতই থেকে যাবে। এই সূচকেও কি ভালো কিছু প্রবণতা দেখা যায়?