হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সার্বিক সচেতনতা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে—‘ডায়াবেটিস সেবা নিতে আর দেরি নয়’। রোগ হিসেবে যার বয়স হাজার বছরের, প্রসার প্রতিপত্তিতে গজেন্দ্রগামী, আহ্বায়ক অনেক অসংক্রামক রোগের, মহামারি আকারে যার বিস্তার ভাবিয়ে তুলছে গোটা বিশ্বকে তাকে চিনতে জানতে, নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধের নাকি এখনই সময়, সেই মহাসর্বনেশে শত্রুরূপী রোগটির নাম ডায়াবেটিস। যুগে যুগে দেশে দেশে তার হরেক নাম—মধুমেহ, বহুমূত্র, ডায়াবেটিস মেলিশাস, এন্ডোক্রাইন এবং মেটাবলিক ডিসঅর্ডারস। 

গোটা বিশ্বে এখন প্রতি আট সেকেন্ডে একজন করে ডায়াবেটিক রোগী মারা যাচ্ছে। এই ভয়াবহ সংবাদ ভাবিয়ে তুলছে গোটা বিশ্বকেই। নীরব ঘাতক স্বভাবের ডায়াবেটিক রোগটি এমনিতে দেহে বহু ব্যাধির (চোখ, হার্ট, কিডনিসহ মূল্যবান অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যাপক ক্ষতিসাধনে সক্ষম) আহ্বায়ক। এই রোগের অব্যাহত অভিযাত্রায় শঙ্কিত সবাইকে এটি নিয়ন্ত্রণে যথা-সচেতন করে তুলতেই আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সাল থেকে ১৪ নভেম্বরকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। 

গত শতাব্দীর শেষার্ধে সংক্রামক রোগগুলোর নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ্বে সবাই উঠে পড়ে লেগেছিল। এতে গুটিবসন্ত, কলেরা, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়ার মতো মহামারি নির্মূলে সফল হয় মানুষ। কিন্তু সুন্দর সাবলীল জীবনযাপনের পথে নীরবে সর্ব কর্মক্ষমতা হরণকারী অ-সংক্রামক রোগ ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি সচেতনতার অনিবার্যতা এবং এর জন্য সুপরিকল্পিত সর্বজনীন উদ্যোগ গ্রহণে তৎপর হয়নি। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি বিশ্ব দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সব দেশের সরকার ও জনগণের তরফে সংহত ও সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) জাতিসংঘকে প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানায়। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির হয়ে বাংলাদেশ সরকার এ আহ্বান জানায়। এতে সাড়া দিয়ে এ সম্পর্কিত সচেতনতা গড়ে তুলতে ১৪ নভেম্বরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ২০০৭ সালে ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ (প্রস্তাব ৬১ / ২২৫)। সেই থেকে জাতিসংঘের সব সদস্য দেশে বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনের দুই শতাধিক সদস্য সংগঠনে, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থা কোম্পানি পেশাজীবী সংগঠন ও ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস নানা প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে পালিত হচ্ছে। ২০০৭ সালেই জাতিসংঘের গৃহীত প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে নীল বৃত্তসংবলিত লোগোটিও নির্বাচিত হয়। নীল বৃত্ত জীবন ও স্বাস্থ্যের ধনাত্মক প্রতীক। নীল রং নীল আকাশকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা সব জাতির সংঘবদ্ধতার প্রতীক। এ কারণে জাতিসংঘের পতাকার রংও নীল। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, ভিত্তি বছর ২০০০ সালে বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৭ কোটি, যা সে সময়ে বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ। সংস্থাটি ২০৩০ সালে এ সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে। 

প্রাদুর্ভাবের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বে টাইপ ২; অর্থাৎ, ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলো। পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে ২০৩০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ১৮০ শতাংশ, আফ্রিকা মহাদেশে ১৬০ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ১৫৫ শতাংশ বাড়তে পারে। বিশ্বে গড় বিস্তার যেখানে ১১৪ শতাংশ, বাংলাদেশে তা ১৪৯ শতাংশ, যা ভীষণ আশঙ্কাজনক। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষামতে, নগরায়ণ, পশ্চিমা খাবার ও সার্বিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কারণে এই রোগের ঝুঁকি ক্রমে বাড়ছে। বিশ্ব রোগ নিরাময় কেন্দ্রের মতে, ২০৫০ সালের আগেই এটি মারাত্মক মহামারিতে রূপ নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ডায়াবেটিস তথ্য কেন্দ্রের হিসাবমতে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এই রোগের কারণে বছরে জাতীয় অর্থনীতির ১৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। 

ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়—এ ধারণাও ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ কমানোর উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণমতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা মেনে; অর্থাৎ, কাজকর্মে, আহারে-বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায় শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়ম-শৃঙ্খলাই ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি। ডায়াবেটিস রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্বন্ধে ব্যাপক শিক্ষা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। একই সঙ্গে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এবং চিকিৎসক ও নার্সদের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করে, তবে তাঁর উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলেন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করেন, তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারেন। 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশ এক থেকে পাঁচ দশক ধরে স্বাধীনতা ভোগ করে এলেও এ দেশগুলোয় আজও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রয়ে গেছে। এটি জাতীয় উৎপাদনের স্বল্পতা, অক্ষরজ্ঞানের নিম্নহার, অনুন্নত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, অপর্যাপ্ত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ব্যাপক অপুষ্টি, উচ্চ জন্ম ও শিশু মৃত্যুর হার এবং পৌনঃপুনিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সংগ্রাম করে চলছে। এতসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি দমনের সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের আয়ুষ্কাল ধীরে ধীরে বাড়ছে। বিপরীতে আবার ডায়াবেটিস মেলাইটাস, উচ্চরক্তচাপের মতো বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য চাই সবার সমন্বয়। 

লেখক: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিলের সদস্য

আরও পড়ুন:

কতিপয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করতে হবে

নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারে কমিশন কী সুপারিশ করল

‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’

টানাপোড়েনের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচন

বার্ধক্য শুরু হয় পা দিয়ে

নো ওয়ান কিলড তিন্নি!

শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই

ভ্যাট বৃদ্ধি ও জনজীবনে চাপ

মানুষ কী চায়

শিশুকে কোন স্কুলে ভর্তি করাবেন

সেকশন