গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী ৪০ বছরের পুরোনো একটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার সকালে কারখানার মূল ফটকে বন্ধ ঘোষণার নোটিশ সাঁটিয়ে দেওয়া হয়। কারখানাটির নাম পলিকন লিমিটেড। কারখানার নির্বাহী পরিচালক ফয়সাল জহিরের সই করা নোটিশে উল্লেখ করা হয়, ‘ডলার-সংকটের কারণে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে কারখানাটি কাঁচামাল আমদানি করতে পারেনি। ২০২৩ সালের জুন থেকে প্রচণ্ড লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানার উৎপাদন ৮০ ভাগ কমে যায়। ব্যাংকের ঋণ, বকেয়া বেতন, গ্যাসের বিল, বিদ্যুতের বিল—কোনোটাই সঠিকভাবে আড়াই বছর ধরে পরিশোধ করতে না পারায় ৪০ বছরের প্রতিষ্ঠানটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো।’
গত এক-দেড় বছরে বিভিন্ন খাতের এমন অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তার মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক পোশাকশিল্পেরও বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা বন্ধের একাধিক কারণ রয়েছে। তবে সবগুলোর ক্ষেত্রেই একটি সাধারণ ও অভিন্ন কারণ গ্যাস-সংকট। যেসব কারখানা চালু রয়েছে সেগুলোও গ্যাস-সংকটে বিপন্নপ্রায়। গ্যাস-সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিঘ্নিত হচ্ছে। সিএনজি ফিলিং স্টেশন এবং আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাস-সংকটের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। অর্থাৎ দেশে এমন কোনো গ্যাসভিত্তিক শিল্প কিংবা সেবা খাত নেই, যেখানে গ্যাসের সংকট নেই। সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও ভালো নেই। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই বাগে আনা যাচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি কিংবা বিদেশি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। ফলে কর্মসংস্থান না থাকার কারণে প্রচুর লোকের কাজ হারানোর ঘটনাও ঘটছে।
এই অবস্থায় সরকার আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। প্রস্তাবিত এই মূল্যবৃদ্ধির হার শিল্পের ক্ষেত্রে প্রায় ২৫০ শতাংশ বা আড়াই গুণ। শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালে নির্বাহী আদেশে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করেছিল। তখন ক্যাপটিভে ১৬ টাকা থেকে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। এরপর গত বছর ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটের দাম আরও ৭৫ পয়সা বাড়ানো হয়। তবে শিল্পে গ্যাস-সংকট কখনোই কাটেনি। সামগ্রিকভাবে দেশে গ্যাসের সরবরাহও বাড়ানো সম্ভব হয়নি। এখন আবার সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বাড়াতে চাইছে সরকার। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে সম্প্রতি পেট্রোবাংলা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে দাম বাড়ানোসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সেই প্রস্তাবে শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা (আমদানি করা এলএনজির প্রাক্কলিত মূল্যভিত্তিক) করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরো গ্যাস বিল হবে নতুন দামে। পুরোনোদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় থাকছে প্রস্তাবে।
এ রকম প্রস্তাবে খুব স্বাভাবিকভাবেই শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। যেমন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘দেশে বর্তমানে ৩৭ শতাংশ শিক্ষিত বেকার। উৎপাদন শিল্প ছাড়া এই বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আসলে আমরা উৎপাদন শিল্প চাই কি না, তা নিয়ে মাঝেমধ্যে সন্দেহ জাগে। কারণ, ব্যাংকঋণের সুদের হার, জ্বালানির দাম কোনোটাই এখন আর উৎপাদন খাতের অনুকূলে নয়।’
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘আমরা এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছি। সরকার আবারও গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে। বিগত সরকার কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছিল। এই সরকারও কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই একই কাজ করছে।’
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, হঠাৎ কেন প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৭০-৭৫ টাকা দিতে হবে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। এতে করে স্থানীয় নতুন ও পুরোনো শিল্পগুলো নিজেদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতায় পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারেও সক্ষমতা হারাবে। তিনি আরও বলেন, ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এটাকে কেন্দ্র করে গত সরকার রপ্তানি প্রণোদনা বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের সুতা ও কাপড় আমদানি করতে হচ্ছে। এতে স্থানীয় টেক্সটাইল শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এলডিসি থেকে উত্তরণ পাঁচ বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করেন তিনি।
শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের এই প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, ‘নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটি বিগত সরকারের আমলের মতো করা হয়নি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করেই সমস্যার সমাধান করা হবে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময়ে আনুমানিক ২৮ লাখ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। এটির ভার সবাইকে নিতে হবে। না হয় অর্থনীতি আরও খাদে পড়বে। বাণিজ্য উপদেষ্টা আরও বলেছেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি সরকারের জন্য সুখকর নয়। তারপরও করতে হবে। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মাধ্যমে শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে।
দাম যে বাড়ানো হবেই, তা বাণিজ্য উপদেষ্টার কথায় স্পষ্ট। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলার সূত্রগুলো থেকে পাওয়া খবরাখবরগুলোতেও তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শিল্পোদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা যদি সরকারের কাঙ্ক্ষিত এবং বিইআরসির ধার্যকৃত দাম দেন, তাহলেও কি তাঁরা অনুমোদিত চাপে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাবেন? সেই নিশ্চয়তা কি সরকার দিতে পারবে? মোটেই না। কারণ, পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন অনুমোদিত লোড (চাহিদা) দৈনিক প্রায় ৫৫০ কোটি ঘনফুট। আর প্রতিদিনের নিশ্চিত চাহিদা হলো ৩৮০ কোটি থেকে ৪০০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে ৩০০ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা সরকার তথা পেট্রোবাংলার নেই। এর মধ্যে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ ২০০ কোটি ঘনফুটের কম। আর দুটি ভাসমান টার্মিনালের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে আমদানি করা এলএনজি থেকে দৈনিক গড়ে সর্বোচ্চ ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যেতে পারে। তার মানে দৈনন্দিন স্বাভাবিক চাহিদার তুলনায় ৮০ থেকে ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থেকেই যাবে। সুতরাং দাম যতই বাড়ানো হোক, শিল্প-বাণিজ্য-বিদ্যুৎ-সিএনজি স্টেশন কিংবা আবাসিক কোনো শ্রেণির গ্রাহকই অনুমোদিত চাপে চাহিদামতো গ্যাস পাবে না।
এই অবস্থাটি দেশের গ্যাস খাতে সৃষ্টি করা একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যখন দেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পরিবর্তে এলএনজি আমদানির নীতি গ্রহণ করেছে, তখনই এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমান্বয়ে এই সংকট প্রকট হচ্ছে। আরও হবে। কবে ও কীভাবে এই সংকট থেকে দেশ উদ্ধার পাবে, তা বলা যাচ্ছে না। কেননা, এই সংকট নিরসনের সঙ্গে দেশের নিজস্ব জ্বালানি সম্পদের অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানো এবং এলএনজি আমদানির জন্য আরও অবকাঠামো (এফএসআরইউ কিংবা স্থলভিত্তিক টার্মিনাল) নির্মাণের সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল কর্মকাণ্ড জড়িত।
লেখক: অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক