Ajker Patrika
হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

দেশের হৃৎপিণ্ডে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে গেল মেয়েটি

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা 

দেশের হৃৎপিণ্ডে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে গেল মেয়েটি
ঢাকার সম্মিলিত সামরিক (সিএমএইচ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল মারা যায় মাগুরায় ধর্ষিত শিশুটি। গতকাল বিকেলেই হাসপাতাল থেকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে তার লাশ নেওয়া হয় মাগুরায়। ছবি: সংগৃহীত

বাঁচল না মেয়েটা। ও কি মুক্তি পেল তাহলে? বেঁচে থাকলে কেমন একটা জীবন পেত সে?

মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়ার এই ট্র্যাজেডি নিয়ে কী লিখতেন শেক্‌সপিয়ার? হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, কিং লিয়ারের পাশে কি আরেকটি নাটক লিখে রাখতেন তিনি? তাঁর স্পর্শকাতর মন কি চিনে নিতে পারত এই শিশুকে?

কোন সংলাপ দিয়ে শুরু করতেন তিনি? ‘মা, বোনের বাড়ি বেড়াতে যাই?’ মেয়েটার এ রকম একটা সংলাপেই কি শুরু হতো নাটকটি?

উত্তরে মা কী বলতেন? বোনেরই তো বাড়িতে যেতে চাইছে। ক্ষতি কী! হেসেখেলে সময় কেটে যাবে ওর। কিছু চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় দিয়ে উদরপূর্তিও হবে!

তিনি কীভাবে জানবেন, বোনের শ্বশুর নামে একটি শ্বাপদ সেখানে অপেক্ষা করছে! শ্বশুর মানে তো অভিভাবক। ভুল করলে শাসন করে, সবাই যত্ন নিচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখে।

অথচ এই শ্বশুরের ছিল যৌনবিকার। পুত্রবধূকেও কুপ্রস্তাব দিয়েছিল সে। শেক্‌সপিয়ার কি তাঁর যুগে এ রকম মানুষের দেখা পেয়েছিলেন কখনো? সবাই তো বলে থাকেন, কত ধরনের আবেগের সঙ্গেই না তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন! বিশেষ করে, তাঁর লেখালেখির আগে কে আর অমন করে জানত, মানুষের জীবনে ‘বিষণ্নতা’ বলে একটি বোধ আছে?

ভোরে সেহরির সময় মেয়েটির জীবন বিষণ্নতায় ভরিয়ে দিয়েছিল বোনের শ্বশুর। ক্ষতবিক্ষত করেছিল ওর কোমল শরীর, কোমল মন। ধর্ষক সেই শ্বশুরের বউ এবং ছেলেও ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল এ ঘটনা!

বোনের সামনে কাঁপতে কাঁপতে এসে দাঁড়ানোয় বোন ভেবেছিলেন, মেয়েটা বুঝি শীতে কাঁপছে!

আহা রে! এই ফুলের মতো ছোট মেয়েটার মন আর শরীরে তখন কী বয়ে চলেছিল? সেই অনুভূতি কি ধরতে পারবেন শেক্‌সপিয়ার?

স্বাভাবিকভাবে ফুঁসে উঠেছিল দেশের মানুষ। মেয়েটি তখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। এক হাসপাতালে নেওয়া হয়, তারা বলে দেয়, ওর চিকিৎসা এখানে হবে না। আরও ভালো চিকিৎসা চাই। হাসপাতাল পাল্টাতে পাল্টাতে ৪ নম্বর হাসপাতালে এসে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করল মেয়েটা। আর অন্যদিকে মেয়েটাকে নিয়ে চলা বিক্ষোভগুলো কেমন যেন ঘুরে গেল অন্যদিকে। প্রকাশ্যে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড নাকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ—তা নিয়ে চলতে থাকল স্লোগান, বক্তৃতা আরও কত কী!

মেয়েটা কিন্তু তার কিছুই জানত না। ও চুপ করে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছিল চলে যাওয়ার জন্য। ও কি কিছু ভাবছিল? শেক্‌সপিয়ার কি এ সময় মেয়েটির মুখে বসিয়ে দিতেন কোনো স্বগত সংলাপ? ও কি রঙিন পোশাক পরে ঈদে কোথায় বেড়াতে যাবে, সে কথা ভাবত? ও কি মনকাড়া গল্পের বই হাতে পেয়ে রোমাঞ্চে চিৎকার করে উঠত? ও কি খোলা মাঠে প্রজাপতি ধরতে গিয়ে হেসে উঠত!

মেয়েটা চলে গেছে। দেশের হৃৎপিণ্ডটায় প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে। সেই হৃৎপিণ্ডটা সে ধাক্কা সামলাতে পারবে কি না, তা কে জানে? হৃৎপিণ্ডটায় নানা আঁচড়। নারীকে তার রুচি অনুযায়ী বাঁচতে দেওয়া হবে কি না, নারী লাঞ্ছনার শিকার হলে নারীকেই বারবার দায়ী করা হবে কি না—এ নিয়ে কি পুরুষেরাই সিদ্ধান্ত নেবে?

মেয়েদের নিয়ে কত রকম অশ্রাব্য কথাই না বলে যাচ্ছে নেটিজেনদের একটা অংশ। শেক্‌সপিয়ারের সৌভাগ্য, তিনি তাঁর আমলে নেটিজেনদের হামলার শিকার হননি; এই যুগে বসবাস করলে তিনি কি নেটিজেনদের হামলা থেকে কি বাঁচতে পারতেন?

এমন একটা সমাজ গড়ে উঠছে, যেখানে বাবার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কন্যা, ক্লাস সেভেনের ছেলেও ধর্ষণ করছে আরও ছোট শিশুকে, যৌনতার লকলকে জিহ্বা বের করে ধর্ষকের দল নারীদের খুঁজছে। সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান, স্নেহ—সব বুঝি হারিয়ে যেতে বসেছে।

শরীর আর মনে বিশাল বিশাল ক্ষত নিয়ে চলে গেল যে মেয়েটি, ও কি আমাদের কোনো বার্তা দিয়ে যায়নি? ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কি এখনো আসেনি?

শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলোয় সমাজ গড়ে তোলার সময় কি এখনো আসেনি?

অন্ধতা দিয়ে নিজেদের বিবেক ঢেকে রাখার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সময় কি এখনো আসেনি?

মেয়েটার ছবি দেখিনি। দেখতেও চাই না। কী হবে দেখে? ওর চেহারার দিকে তাকালে জাতির জন্য এক তীব্র অসম্মানজনক দৃশ্য ভেসে উঠবে চোখে। সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর জন্য কি আমরা প্রস্তুত হয়েছি?

আজই পত্রিকায় নতুন কোনো ধর্ষণের সংবাদ পড়তে হবে না তো?

এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসার জন্য আমাদের কোনো প্রস্তুতি আছে কি?

টু বি অর নট টু বি, দ্যাটস দ্য কোয়েশ্চেন!

ভারতের দুমুখো নীতিই সম্পর্কোন্নয়নের অন্তরায়

নির্বাচন নিয়ে সংশয় কেন

আমরা কি শুধু মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকব

এনআইডি নিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান নতুন বিতর্ক তৈরি করবে

ধর্ষণ প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব

শব্দের আড়ালে গল্প: ফ্যাঁকড়া

তরুণেরাই মোড় পরিবর্তনের দিশারী

আমাদের গণতন্ত্র এবং কাঠমান্ডুর অভিজ্ঞতা

ক্ষমতার বদল নয়, বদল ঘটাতে হবে ব্যবস্থার

স্বপ্ন আছে বলেই আমরা এখনো আছি