হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

মুরাদের মতো মুরোদওয়ালা কি আর নেই?

অর্ণব সান্যাল

দোষী একজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও দোষ চিহ্নিত করা হয়নি। তবে প্রতিমন্ত্রী মশাই যে ‘উল্টো–পাল্টা’ করেছেন, তা মোটামুটি নিশ্চিত। নইলে কি আর এ দেশে কাউকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ আসে? কিন্তু তাতেই কি সব মুরোদওয়ালা সোজা হয়ে যাবে? 

সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। সেসবের মধ্যে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের বিরুদ্ধে কটূক্তি আছে, আছে একজন চিত্রনায়িকাকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার বিষয়টিও। আর এসব নিয়ে মাঠ গরম হতে না হতেই আসতে থাকল একের পর এক অভিযোগ। 

ধারাবাহিকভাবে জানা গেল, সচিবালয়ের কর্মকর্তারাও নাকি মুরাদ হাসানের খারাপ ব্যবহারে অতিষ্ঠ। তাঁর নির্বাচনী এলাকা জামালপুরের সরিষাবাড়ী থেকেও একই খবর এল। বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে মুরাদ হাসানকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে বদলির পেছনেও নাকি তাঁর বাজে ব্যবহার প্রভাবক ছিল। আর এসব খবর মিলে যেতে লাগল মুরাদ হাসানের সেই বক্তব্যের সঙ্গে, ‘আমার মুখ ভীষণ খারাপ’। 

এ দেশে গত কয়েক বছরে একটি বিষয় লক্ষণীয়। কেউ ভালোভাবে ফেঁসে গেলে, সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে যায়। অনেকটা কারেন্ট জালে আটকানোর মতো বিষয়টা। যতই মাছ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করুক না কেন, জালে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে যেতে হয়। বের হতে থাকে একের পর এক বিতর্কিত ভিডিও, অডিও, কল রেকর্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। বিষয়টি এমন যে, সবাই সব বিতর্ক পকেটে পুরে বসেছিলেন। আর যে-ই না ম্যাচের কাঠি জ্বলল, অমনি দাবানল বনে গেল! 

এখন যদি প্রশ্ন ওঠে যে, শুধু কি মুরাদ হাসানেরই মুরোদ ছিল অভিযোগ তোলানোর মতো অপরাধ করার? নাকি আরও অনেকেরই এমন আছে? হয়তো সেসব কীর্তিকলাপ কোথাও না কোথাও জমা হয়ে তা দিচ্ছে, একদিন আলোর মুখ দেখবে। কারণ এ দেশে সবকিছুরই যে সময় ঠিক করা আছে! যেদিন গায়েবি আদেশ হবে, সেদিনই লাগবে গন্ডগোল। 

আর এই জায়গাতেই আছে সমস্যার মূল। আমরা হরহামেশা পত্রপত্রিকায় হাজারো অভিযোগ–অপরাধের খবর পাচ্ছি। চলমান ইউপি নির্বাচনের কথাই ধরুন। কেউ নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট না দিলে ক্রসফায়ারের হুমকি দিচ্ছেন, কেউ দিচ্ছেন ‘লাইনে’ না থাকলে বা অনুগত না থাকলে কড়কে দেওয়ার সতর্কতা। কেউ আবার সরকারি চাকরি করে প্রশাসনিক পদে থেকে কারও ছাল-চামড়া তুলে নেওয়ার কথা বলছেন প্রকাশ্যে, অবলীলায়। সবই কিন্তু হচ্ছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ছত্রচ্ছায়ায়। আরও স্পষ্ট করে বললে, এসব কিছুর মূলে আছে ক্ষমতার চর্চা। সেই সর্বগ্রাসী ক্ষমতা তৈরিই হয়েছে রাজনীতি ভুল পথে যাওয়ায়, ভুল প্রক্রিয়ায় একক আধিপত্য তৈরি করায়। কারণ, একাধিপত্য তৈরি না হলে ক্ষমতা একচ্ছত্র হয় না। ঠিক তেমন ক্ষমতার ছায়াতেই একেকজন দলীয় ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় পদে থেকেও একজন স্বাধীন নাগরিককে ‘তুলে’ নেওয়ার হুমকি দিতে পারেন। 

রাষ্ট্রীয় পদ এখন কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা গেছে চলমান ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের তালিকা দেখে। ক্রমান্বয়ে সংসদ সদস্য পর্যন্ত সব পদেই আছে এ তালিকা, যাঁরা যেকোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে ইচ্ছুক। আসলে এ দেশের প্রশাসনিক পুরো কাঠামোই ক্ষমতাবান্ধব হয়ে গেছে। পাঠক, আপনারা কি কেউ বলতে পারবেন সর্বশেষ কবে শুধু নাগরিক হিসেবে কর্তৃপক্ষের শ্রদ্ধা পেয়েছেন? সেটি নেই বলেই সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এখন নাগরিকের মুখে ‘স্যার’ ডাক না শুনলে ক্ষেপে যান। কারণ, সাংবিধানিকভাবে জনগণের প্রতি নিবেদিত সরকারি কাঠামো এখন বাস্তবে ক্ষমতার প্রতি নিবেদিত। আর সামাজিকভাবে প্রতিটি মানুষ যখন এসব দেখেই অভ্যস্ত হয়ে যান, তখন তাঁরাও টিকে থাকার জন্য ধীরে ধীরে হতে থাকেন ক্ষমতার পূজারি। সেই পূজা তখনই শেষ হয়, যখন ক্ষমতা আর উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটির পকেটে থাকে না। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও কি বিষয়টি তেমনই? 

যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে ক্ষমতার বাড়বাড়ন্ত এ দেশের যত কোনায় আছে, সেসব স্থানে মুরোদওয়ালা এমন মানুষ মিলবে টনকে টন। হিসাব করে লিখে রাখাও কঠিন হবে। শুধু একবার চোখ বন্ধ করে চারপাশের কথা ভাবুন তো! কী, পাচ্ছেন না? 

মুরাদ হাসান ‘মুখ খারাপ’ করে হুমকি দেওয়ার পর এখন অবশ্য ক্ষমা চাইছেন। তিনি ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি অথবা আমার কথায় মা-বোনদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকি, তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।’ ক্ষমা যখন চেয়েছেন, তখন অবশ্যই তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, ভুল কিছু না কিছু হয়েছে। কিন্তু মুখ খারাপ করার পর একটি স্ট্যাটাসে ক্ষমা চাইলেই কি সব দোষ মাফ হয়ে যায়? যদিও এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপের অধিকাংশ নাগরিক তেমন স্মৃতিধর নন। নানা ঝঞ্ঝাট, সময়ও কম। ফলে কিছু ভুলে যেতে খুব একটা সময় লাগে না। নইলে কি আর ‘মুখ খারাপ’ রাজনীতিক তিন তিনবার সংসদে পা রাখেন? হয়তো সেই সুযোগটাই সংশ্লিষ্টরা নিতে মরিয়া। 

নাকি এ দেশের নাগরিকদের ক্ষমা করতেই হবে? কে জানে, অদূরভবিষ্যতে সেই ক্ষমা করতে বাধ্য হওয়ার ধমকিও আসে কি না! 

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি