বাংলা নববর্ষ বরণকে কেন্দ্র করে আমাদের নগরকেন্দ্রিক জীবনে উপচানো আবেগ-উচ্ছ্বাস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই আবেগ-উচ্ছ্বাস জাতিগত পারস্পরিক সৌহার্দ্যের নয়, সমষ্টিগতও নয়, একান্তই আত্মকেন্দ্রিকতায় সীমাবদ্ধ। স্বীকার করতেই হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ বাঙালির জীবনে দিনটির প্রভাব মোটেও নেই। কারণও অস্পষ্ট নয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাই প্রধান কারণ।
এই ঢাকাতেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালি মুসলমানদের বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে উৎসব-আনুষ্ঠানিকতা দেখিনি। সামাজিক ও পারিবারিক কোনো ক্ষেত্রেই নববর্ষকেন্দ্রিক আচার-অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো ছিল, তবে খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ে দিনটি শুরু হতো ধর্মীয় আচার-আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে, যা আজও বলবৎ রয়েছে। আমার হিন্দু সহপাঠীদের বাড়িতে যেতাম এবং দেখতাম তাদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে নববর্ষের উৎসবের আমেজ। নারীরা বুড়িগঙ্গা নদীতে স্নান শেষে নতুন শাড়ি গায়ে জড়িয়ে, শাঁখা-সিঁদুর লাগিয়ে হাতে আমের শাখা, ঘট ইত্যাদি পূজার উপকরণ নিয়ে অভুক্ত অবস্থায় ছুটত মন্দিরের উদ্দেশে। পূজা শেষে বাসায় ফিরে আহার করত, তার আগে নয়। বাড়িতে বাড়িতে উন্নত রান্না হতো। অতিথি আপ্যায়নের জন্য দই-মিষ্টি, মৌসুমি ফলমূল সবাই বাড়িতে এনে রাখত। ওই দই-মিষ্টির আকর্ষণে হিন্দু সম্প্রদায়ের সহপাঠী বন্ধুদের বাড়িতে যেতাম দল বেঁধে। দেখতাম মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময়ে একে অপরের বাড়িতে যেতে-আসতে। অতিথিদের আসা-যাওয়া, শুভেচ্ছা বিনিময় ইত্যাদি সামাজিকতা ছিল অনিবার্য। বন্ধুদের বাড়ির পর ছুটতাম হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসাকেন্দ্রে—ওই, মিষ্টির আকর্ষণে। ক্রেতা সেজে দরদাম করামাত্র বিক্রেতা হাতে মিষ্টির ঠোঙা ধরিয়ে দিতেন। মিষ্টি হাতে পেয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে ছুটতাম অন্য দোকানে। দেখতাম পুরোহিত দিয়ে ব্যবসাকেন্দ্রে পূজা করানো, গীতাপাঠ, ধূপের ধোঁয়ায় পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ। ব্যবসায়িক উন্নতির জন্য প্রার্থনা ইত্যাদি। অর্থাৎ, বাংলা নববর্ষের পারিবারিক ও সামাজিক আনুষ্ঠানিকতায় ধর্মযোগ ছিল অনিবার্য। নববর্ষের দিনটি তাদের ধর্মীয় আচারেরই অংশ। আজও তেমনি রয়েছে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ যেকোনো মন্দিরে সকালে গেলে দেখা যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বৈশাখী পূজা অনুষ্ঠানে উপচে পড়া ভিড়।
চৈত্র মাসের শেষ দিনে অর্থাৎ, চৈত্রসংক্রান্তিতে লালবাগের শ্মশানঘাটের পাশে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে চৈত্রসংক্রান্তি মেলা হতো। বিশাল প্রাঙ্গণজুড়ে মেলার সামগ্রিক উপকরণের ঘাটতি ছিল না। রমরমা মেলা বলতে যা বোঝায়, সবই ছিল সেখানে। মেলার আকর্ষণে আমরা দল বেঁধে ছুটে যেতাম এবং মেলা শেষে প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরতাম। চৈত্রসংক্রান্তির বিকেলে বৃষ্টি ছিল প্রায় অনিবার্য। এখন সেটা আর দেখা যায় না। স্থানীয়রা ওই মেলাকে ‘চৈতপূজার মেলা’ নামে অভিহিত করত। চৈত্রসংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ ছিল কেবল বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মুসলিম সম্প্রদায়ের নগণ্যসংখ্যক বাঙালি হয়তো পালন করত, কিন্তু নববর্ষকেন্দ্রিক আচার-আনুষ্ঠানিকতায় হিন্দু সম্প্রদায়ের একক আধিপত্য ছিল। এই অজুহাতে পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলা নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতায় হিন্দুয়ানি মোড়ক সেঁটে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। নানা প্রচার-প্রচারণায় দিনটিকে হিন্দুদের ধর্মীয় পূজা-পার্বণের সঙ্গে তুলনা করত।
এটাও সত্য, বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ে দিনটির গুরুত্ব-প্রভাব মোটেও ছিল না। একমাত্র মুসলিম সম্প্রদায় ব্যবসাকেন্দ্রে হালখাতা নবায়ন, হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুকরণে মৌলভি দিয়ে মিলাদ পড়ানো ছাড়া সামাজিক ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে কোনো আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করত না। অপ্রিয় হলেও সত্য; বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থ-বিত্তে, জমি-জমিদারিতে ছিল অগ্রসর। অপরদিকে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায় ছিল পশ্চাৎপদ। বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের পূর্ব পর্যন্ত হিন্দু মধ্যবিত্তের ছিল একক কর্তৃত্ব। বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের বিকাশে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্বই দেশভাগে গতি পেয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্তের টানাপোড়েনের সুযোগেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত হয়েছিল অবিভক্ত বঙ্গে। সেটা আরেক ইতিহাস। বাস্তবতা হচ্ছে, মধ্যবিত্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের একক আধিপত্যের দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় পয়লা বৈশাখ, নববর্ষ উদ্যাপন হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচারের অংশে পরিণত হয়।
বাংলা ও বাঙালির প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মানার্থে কিন্তু বঙ্গাব্দের প্রচলন করেননি সম্রাট আকবর। একমাত্র উদ্দেশ্য বাংলার ঋতু-প্রকৃতিকে উপলক্ষ করে খাজনা আদায়। ভারতবর্ষে কৃষি অর্থনীতির বিকাশে সম্রাট আকবরের ভূমিকা নিশ্চয় রয়েছে। জমির পরিমাপ নির্ধারণসহ অনাবাদি জমিকে ফসল ফলানোর উপযোগী করতে ছিল তাঁর কঠোর আদেশ-ভূমিকা। কৃষিব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেছিলেন কৃষকের স্বার্থে নয়, ভূমির রাজস্ব আয়ের পথ সুগম করতে। প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল কৃষকদের থেকে নিয়মিত খাজনা আদায়। মোগল সম্রাটদের রাজ্য দখল, লুণ্ঠনপ্রক্রিয়ার পাশাপাশি বাৎসরিক নিয়মিত খাজনাপ্রাপ্তির স্থায়ী আর্থিক বনিয়াদের অভিপ্রায়ে ভূমিব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়েছিলেন সম্রাট আকবর। ব্যবস্থাটি কালক্রমে পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত হয়ে স্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। রাজা-নবাবদের রাজস্বের দাবি মেটাতে স্থানীয় জমিদারেরা নিষ্ঠুর পন্থা অবলম্বনে দ্বিধা করত না। আদায়কৃত বাৎসরিক খাজনার নিজেদের ভাগের অংশ রেখে বাকি সমস্ত অংশ স্থানীয় রাজা-নবাবদের কাছে পাঠাতেন। রাজা-নবাবেরাও অনুরূপ প্রাপ্ত খাজনা থেকে নিজেদের অংশ রেখে অবশিষ্ট অর্থ সম্রাটের দরবারে পাঠাতেন। বাৎসরিক খাজনা প্রদানের সময় জমিদার-জায়গিরদার স্বয়ং কিংবা তাদের প্রতিনিধিকে রাজা-নবাবদের দরবারে উপস্থিত হতে হতো। একইভাবে রাজা-নবাব কিংবা তাদের প্রতিনিধি সম্রাটের দরবারে উপস্থিত থেকে খাজনার অর্থ কড়ায়-গন্ডায় বুঝিয়ে দেওয়ার প্রচলন ছিল।
রাজা-নবাবদের ধার্য করা বাৎসরিক খাজনা প্রদানে অসমর্থ জমিদারদের জমিদারির অধিকার রাজা-নবাবেরা কেড়ে তার স্থলে অন্য জমিদার নিয়োগ দিতেন। জমিদারি রক্ষার তাগিদে জমিদারদের চরম নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হতে হতো হতভাগ্য কৃষকদের। খাজনা পরিশোধের শেষ সময়সীমা ছিল চৈত্রসংক্রান্তির দিনটি। ওই দিনের মধ্যে খাজনা পরিশোধ করা না-করার ওপর কৃষকের ভাগ্য নির্ধারিত হতো। সে কারণে পয়লা বৈশাখের তাৎপর্য ও গুরুত্ব সম্রাট, নবাব, জমিদার এবং অসহায় প্রজা-কৃষক সবার কাছেই ছিল, তবে চরম বৈপরীত্যে।
ইংরেজ কোম্পানির শাসনাধীনে বঙ্গদেশে পয়লা বৈশাখে খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে পুণ্যাহ উৎসবের প্রবর্তন হয়েছিল। লর্ড ক্লাইভ প্রবর্তিত পুণ্যাহ হচ্ছে পয়লা বৈশাখে ভূমি রাজস্ব বিভাগের শুভ নববর্ষ। লর্ড ক্লাইভ শুরুতে নবাবি আমলের জমিদারদের পরিবর্তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের মাধ্যমে খাজনা আদায়ের উদ্যোগ নিলেও আশানুরূপ সাফল্য না পাওয়ায় পুনরায় স্থানীয় নিয়োগকৃত জমিদারদের মাধ্যমে খাজনা আদায়ের পূর্ববর্তী ব্যবস্থায়
ফিরে যেতে বাধ্য হন। ক্লাইভের আমলে জমিদারমাত্রই ছিল খাজনা সংগ্রাহক। নবাবের আমলের মতো তাদের সম্মান-মর্যাদা বলে কিছু ছিল না। তবে শাসক সহযোগী ভূমিকায় ইংরেজ শাসনের আনুগত্যে জমিদার শ্রেণি কৃষক-প্রজা নিপীড়নে সিদ্ধহস্ত ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার প্রবর্তনে খাজনা আদায়ের অর্থনৈতিক শোষণমূলক ব্যবস্থাটি চতুর ইংরেজ কোম্পানি স্থায়ী করেছিল।
লর্ড ক্লাইভের পুণ্যাহ সূচনাই প্রকৃতপক্ষে বাংলা নববর্ষের বর্ষবরণের জন্মকথা। ইংরেজ বিদায়ের পর বাঙালির সব ক্রিয়াকর্মের মূলে দিনটির গুরুত্ব সম্পূর্ণরূপে ম্লান হয়ে যায়নি। নানা উপায়ে সেটি টিকে আছে। আজও দেখা যায়, দেশের সমস্ত তহশিল অফিসসমূহে বঙ্গাব্দের অনুসরণে বাৎসরিক খাজনা আদায়ের চিরায়ত নিয়ম-ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। পয়লা বৈশাখের দিনটি ছাড়া দ্বিতীয় একটি দিনও নেই, যেটি বঙ্গাব্দের সাল-তারিখের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয়ভাবে পালিত হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সীমিত আকারে বাংলা নববর্ষ পালনের আনুষ্ঠানিকতা শহরকেন্দ্রিক শুরু হয় এবং পর্যায়ক্রমে মাত্রাটা দেশের সমস্ত শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের মিডিয়া, করপোরেট পুঁজি, উৎপাদকেরা পণ্য বিপণনে দিনটিকে চরম ভোগবাদিতার অভিমুখে নিয়ে গেছে।
ঈদ বা শারদীয় পূজার কেনাকাটার থেকেও দিনটি ক্রমেই আরও অধিক বিস্তৃতি লাভ করেছে। জাতীয় দৈনিকে পয়লা বৈশাখের নানা আয়োজন-বিজ্ঞাপনের ফাঁদে নববর্ষকেন্দ্রিক খাদ্য, পোশাক, ভোগ-বিলাসিতার এবং নানা পণ্যের প্রচারণার আধিক্য দেখা যায়। টিভি মিডিয়ায় বর্ণিল বৈশাখের ফ্যাশন শোর সম্প্রচারও চলে। এগুলোকে সরলভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। মানুষকে সুকৌশলে ভোগবাদিতার অভিমুখে ঠেলে দেওয়ার নানা মতলব এতে আমরা প্রত্যক্ষ করি। পণ্যের পসরা সাজিয়ে ভোগবাদিতার অভিমুখে মানুষকে ঠেলে দেওয়ার নানা তৎপরতা নববর্ষ উদ্যাপনের ক্রম বিস্তারে এখন অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে। দিনটি নারী নিপীড়নের ক্ষেত্রেও পরিণত হয়েছে। বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির বিপরীতে উগ্র অপসংস্কৃতির আধিক্য আমাদের কোন পথে ঠেলে দিচ্ছে, সেটা কি আমরা বিবেচনা করি? থার্টি ফার্স্টের উগ্রতা পয়লা বৈশাখে ভর করেছে, এই সত্য অস্বীকার করি কীভাবে?
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত