রমনা উদ্যানকে বলা হয় ‘রমনা গ্রিন’। রমনা নামটা রেখেছিলেন মুঘলরাই। ফারসি শব্দ ‘রমনা’ মানে সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ বা ‘লন’। হয়তো উদ্যান হয়ে ওঠার আগে রমনা সেরকম সবুজ মাঠই ছিল, পরবর্তী সময়ে হয় জঙ্গল। কালক্রমে সেই সবুজ জঙ্গলটাই হয়ে ওঠে ঢাকা শহরের ফুসফুস। রমনা প্রায় ২০০ প্রজাতির গাছপালায় সাজানো এক মনোরম রমণীয় উদ্যান, যেখানে গাছের সঙ্গে রয়েছে জলাশয় ও উদ্যানপথ। তাই সকাল-বিকেল সাধারণ মানুষের হাঁটা ও বেড়ানোর এক চমৎকার জনপ্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছে রমনা উদ্যান। ঢাকা শহরের যেকোনো জায়গার চেয়ে সেখানে গেলে শীতল মনে হয়, ঘন সবুজের দিকে তাকিয়ে চোখের আরাম হয় আর বিভিন্ন মৌসুমে ফোটা ফুলের বাহারি রূপে রূপবতী রমনাকে দেখে মুগ্ধ হতে হয়। তবু রমনা জাতীয় উদ্যান নয়, নগর উদ্যান।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি ঢাকা শহরের সবচেয়ে অভিজাত ও দামি এলাকা ছিল শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজার, পাকিস্তান আমলে ধানমন্ডি, এখন গুলশান-বনানী। অথচ উনিশ শতকেরও আগে মুঘল আমলে রমনা ছিল একটি অভিজাত এলাকা, যা ব্রিটিশ আমলে হয়ে পড়েছিল জঙ্গলাকীর্ণ। রমনার উত্তরে ছিল ঘন জঙ্গল। সেই এলাকাকে পরিষ্কার করার পর তা অভিজাত শ্রেণির বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হয়। রমনা এলাকার মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছিল দু-তিনটি খাল। লোকেরা গাছে ঢাকা সেই সব খালে নৌকায় করে ঘুরে বেড়াত। ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরের পর মুঘল আমলের শেষ দিক থেকে রমনার সেই আভিজাত্য নষ্ট হতে শুরু করে। কোম্পানি আমলে সেটি হয়ে পড়ে একটি জঙ্গল, যেখানে অনেক বন্য জীবজন্তুর বিচরণ ছিল, জলাশয় পূর্ণ ছিল ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশককুলে। সেসব মশার উৎপাতে ও ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাবে ইংরেজরা পল্টন থেকে সেনাছাউনি সরিয়ে নিতেও বাধ্য হয়েছিল।
ইংরেজ আমলে সেই জঙ্গলাকীর্ণ বিধ্বস্ত রমনাকে পরিষ্কার করে তার ঐতিহ্য ও আভিজাত্য পুনরুদ্ধারে হাত দেন ঢাকার তৎকালীন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডয়েস। তিনি ১৮২৫ সালে জেলের কয়েদিদের নিয়ে রমনার জঙ্গল পরিষ্কারে নেমে পড়েছিলেন। তিন মাস পর সেই সব জঙ্গল পরিষ্কার হলে সেখানকার একটি অংশে কাঠের রেলিং দিয়ে ঘিরে তৈরি করেছিলেন রেসকোর্স ময়দান, যা আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য তিনি রেসকোর্সের উত্তর-পূর্ব দিকে তৈরি করেছিলেন একটি রাস্তা, যেটি আজ বারডেম হাসপাতালের সামনে থেকে মৎস্য ভবন হয়ে চলে গেছে পল্টনের দিকে। রাস্তাটির বর্তমান নাম কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভেনিউ।
অন্যদিকে রাস্তার পূর্ব দিকে ডিম্বাকার একটি অংশ বের করে জলাশয়সহ তৈরি করা হয়েছিল সবুজের গালিচা ও গাছপালা দিয়ে সাজানো এক মনোরম উদ্যান, যা আজকের রমনা পার্ক। পার্কের উত্তর-পূর্ব দিকের মিন্টো রোড ও হেয়ার রোডে এবং রেসকোর্সের পাশে রাস্তার দুপাশে তখন লাগানো হয়েছিল দুষ্প্রাপ্য সব গাছপালা। সেগুলোর মধ্যে সেগুন একটি। রমনা উদ্যানের ভেতরে রয়েছে শতবর্ষী মহুয়া, কুসুম, বুদ্ধনারকেল, মেঘশিরীষ, বকুল, মাইলাম, পাদাউক, তেলশুর ইত্যাদি গাছ। আজও সেকালের সাক্ষী হয়ে সেগুলো আমাদের সামনে সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছায়াময় মায়াবতী এসব শতবর্ষী গাছ রক্ষা করা এখন সবার দায়িত্ব।
রূপসী রমনা উদ্যানের সবুজ গাছপালা ও সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ আমাদের প্রশস্তি দিলেও রমনা উদ্যানের কিছু বিষয়কে প্রকৃতিবিদেরা ঠিক মেনে নিতে পারেন না। রমনা উদ্যান কি আমাদের দেশীয় গাছপালায় সাজানো যেত না? মানছি যে রমনা উদ্যানের স্থপতি প্রাউডলক রমনায় বিদেশ থেকে অনেক গাছের চারা এনে লাগিয়েছিলেন। সে জন্য সেখানে সেগুলো কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। কিন্তু এমন কিছু আগ্রাসী বিদেশি গাছের আধিক্য দেখা যায়, যেগুলো বাঞ্ছিত না, যেগুলো প্রাউডলক লাগাননি। রমনা উদ্যানের ভেতরে ২ হাজার ৮৬৬টি বৃক্ষ রয়েছে। এসব বৃক্ষের মধ্যে অধিকাংশই মেহগনি, রেইনট্রি, ইউক্যালিপটাসের মতো আগ্রাসী বৃক্ষ। এর মধ্যে মেহগনি গাছই আছে আড়াই শতাধিক। আমগাছও আছে দুই শতাধিক। কোনো উদ্যানেই একই প্রজাতির এতগুলো গাছ থাকা উচিত নয়, থাকা উচিত বেশি প্রজাতির গাছ। তাতে বহু জীববৈচিত্র্যেরও সমাগম ঘটে।
সমীক্ষায় দেখা যায়, রমনা উদ্যানে মোট ২১১ প্রজাতির গাছ রয়েছে। বাস্তবে রয়েছে এর চেয়ে কম। প্রবীণ আলোকচিত্রী ও শিল্পী কে বি আল আজাদ তাঁর বাসায় প্রায় ৫০ বছর আগে তোলা একটি ছবি দেখিয়েছিলেন। ছবিটা ছিল এক বিশাল গিলালতা গাছের। সেটি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। মারা গেছে নিসর্গী দ্বিজেন শর্মার লাগানো কনকচাঁপা গাছও। আবার নতুনভাবে লাগানো হয়েছে উদাল, আমচুন্দুল, পালাম, কুরচি ইত্যাদি গাছ। অনেক গাছের পাশে সেগুলোর নামফলক লাগানো হয়েছে পরিচিতির জন্য। যদিও বেশ কিছু নামের সঙ্গে গাছ মেলে না। আবার খুব অচিন গাছের পাশে কোনো নামফলকও খুঁজে পাওয়া যায় না। বিদেশের কোনো কোনো পার্কে গাছের পরিচিতি ফলকে একটি কিউআর কোড জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে আগ্রহী কেউ কোডটি স্ক্যান করলে গাছটির যাবতীয় পরিচয় ও বৃত্তান্ত জানতে পারেন। কিন্তু আমাদের তো কোন গাছ কবে কে লাগিয়েছিলেন, সেটাই কেউ জানে না। কোনো রেজিস্টারে সেসব তথ্য লিপিবদ্ধ করা নেই। তাই কুসুম ও পাদাউক গাছকে আন্দাজ করে বলতে হয় শতবর্ষী গাছ। কোন গাছ কোথা থেকে বা কোন দেশ থেকে আনা হয়েছিল, তা-ও জানা যায় না। এমনকি উদ্যানের কোথাও গেলে রমনা উদ্যানে থাকা গাছপালার কোনো তালিকাও পাওয়া যায় না। উদ্ভিদপ্রেমীদের কৌতূহল নিরসনের জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তর কি এসব কাজ করতে পারে?
বছর পাঁচেক আগে রমনা উদ্যানটি পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিইএস) সেই সমীক্ষায় দেখা যায়, রমনা উদ্যানের ৬২ শতাংশ এলাকা বৃক্ষাচ্ছাদিত এবং ১১ শতাংশে নানা ভৌত অবকাঠামো রয়েছে। ভৌত অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে একটি সুদৃশ্য রেস্তোরাঁ ও সুপ্রশস্ত রাস্তা। কোনো আদর্শ পার্কেই মোট আয়তনের ২ শতাংশের বেশি ভৌত অবকাঠামো থাকা শোভনীয় ও বাঞ্ছনীয় নয়। সেখানে রমনা উদ্যানে পাকা পিচঢালা রোড কেন করা হলো? পার্কের ভেতরে কি ভিআইপিরা গাড়ি চড়ে ঘুরবেন? নাকি হেলিকপ্টার নামবে? ছোট এই উদ্যানের ভেতরে রাস্তা রয়েছে ১০ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার। রেস্তোরাঁ কেন? লেকের ধার ধরে রেলিং দেওয়া ব্রিজের মতো পথ কেন? এসব বেখাপ্পা কাঠামোর কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা উদ্যানের ভেতরে গাছের গোড়ায় পাকা বেষ্টনীসহ বেঞ্চ ও সড়ক মিলে ১ হাজার ১১৬টি স্থাপনা ছাড়াও বিশাল এলইডি টিভি, রয়েছে শিশু পার্ক ও ব্যায়ামের স্থাপনা। এতে উদ্যান নামের আদি বৈশিষ্ট্য আর এখন রমনার নেই, আবার সুদৃশ্য নগর উদ্যানের সেই নান্দনিকতাও নেই। রমনা উদ্যানকে একটি প্রাকৃতিক উদ্যানে ফেরানোর পথ কি এখন আর খোলা আছে? কিছু সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রমনা উদ্যানকে একটি পূর্ণ উদ্যানের মর্যাদা দেওয়া হোক, জঙ্গল নয়।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক