গণ-অভ্যুত্থানের সাড়ে ৫ মাস পরে এসে জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যে যাতে ফাটল না ধরে, সে ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারকে পরামর্শও দিয়েছে দলটি।
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ দলের এই অবস্থানের কথা জানান।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের নিয়ে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এই বৈঠক শুরু হয় বিকেল সোয়া ৪টায়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও বৈঠকে অংশ নেন। দলগুলোর নেতারা ঘোষণাপত্র নিয়ে দলের অবস্থায় বৈঠকে তুলে ধরেন এবং বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপেও তা নিয়ে কথা বলেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পাঁচ মাস পর গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর ওই ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচিও দেয় তারা। এ বিষয়ে ২৯ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নাৎসি বাহিনীর মতো অপ্রাসঙ্গিক এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের কবর রচনা করা হবে।’
এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা-সমালোচনার মুখে ৩০ ডিসেম্বর সরকার ঘোষণা দেয়, ঐকমত্যের ভিত্তিতে তারাই ঘোষণাপত্র তৈরি করবে। তখন ৩১ ডিসেম্বর ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচি বদল করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে তারা এ জন্য সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। নির্ধারিত সেই তারিখের এক দিন পর গতকাল দলগুলোকে নিয়ে বৈঠকে বসল সরকার।
বৈঠকে বিএনপির যোগ দেওয়া নিয়ে সকালের দিকে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। তবে সেই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত দলের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ওই বৈঠকে অংশ নেন সালাহউদ্দিন।
বৈঠক শেষে বেরিয়ে সালাউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা (বিএনপি) প্রশ্ন করেছি, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের আসলেই সাড়ে পাঁচ মাস পরে কোনো প্রয়োজন ছিল কি না? যদি থেকে থাকে, সেটার রাজনৈতিক গুরুত্ব, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং আইনি গুরুত্ব কী? সেগুলো নির্ধারণ করতে হবে। ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে যাতে কোনো ফাটল সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ‘যদি কোনো রাজনৈতিক দলিল ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়, সেই দলিলটাকে অবশ্যই আমরা সম্মান করি। কিন্তু সেটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যাতে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে পরামর্শ নেওয়া হয়, আলোচনা করা হয়, সে ব্যাপারে আমরা পরামর্শ দিয়েছি। এই বিষয়ে নজর রাখতে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের অনুরোধ করেছি।’
সালাহউদ্দিন আরও বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, সেই জাতীয় ঐক্যকে গণ-ঐক্যে রূপান্তরিত করে সেটাকে যাতে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে নিয়ে আসতে পারি, এটাই এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই প্রচেষ্টা থেকে আমরা যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম, তাদের সবাইকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে চাই। এখন যেকোনো রকমের অনৈক্যের বীজ যাতে আমাদের ভেতরে বপন না করতে পারে কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি এবং তাদের দোসররা, সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।’
বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর চার সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, একটা ঘোষণাপত্র হওয়া প্রয়োজন, প্রতিটি দল সেটা অনুভব করেছে। তবে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ৫ আগস্টের মূল চেতনাকে ধারণ করে ঘোষণাপত্র তৈরিতে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এ জন্য সময় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের জন-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে, অভ্যুত্থানের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস, স্বাধীনতার পূর্বাপর ইতিহাসসহ সবকিছু মিলিয়ে একটা সুলিখিত ঘোষণাপত্র কীভাবে তৈরি করা যায়, সে আলোচনা হয়েছে। জামায়াত এ বিষয়ে পৃথক প্রস্তাবনা দেবে বলেও জানান তিনি।
তবে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়নে খুব বেশি বিলম্ব না করতে জামায়াতের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান পরওয়ার। তিনি বলেন, দেরি না করে এই উদ্যোগ দ্রুত শুরু করা উচিত।
ঘোষণাপত্র তৈরিতে তাড়াহুড়ো ও যেনতেন প্রক্রিয়ায় করা না হয় বলে জানিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বলেছি, এটা যেন তাড়াহুড়ো করে যেনতেন প্রক্রিয়ায় করা না হয়।’
তবে জোনায়েদ সাকি এ কথাও বলেন, ‘এটা কী হবে? এটার আইনের দিক কী? রাজনৈতিক দিকগুলো কী? এ প্রশ্নগুলো সবার ঐকমত্যে হবে।’
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ‘ঘোষণাপত্র নিয়ে আমরা একটি লিখিত পরামর্শ দিয়েছি। আকার ছোট করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল বলেন, ‘যদিও ১৫ জানুয়ারি মধ্যে ঘোষণাপত্র জারি করতে পারবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। সরকারকে সেভাবে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। তারপরও তারা যে উদ্যোগ গ্রহণ করছে, তার জন্য সাধুবাদ জানিয়েছি।’
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি জুনাইদ আল হাবিব বলেন, ‘ঘোষণাপত্রের জন্য আমরা একটা কথা বলে এসেছি, অনেকগুলো বিষয় যেহেতু এখানে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু সেই জায়গায় ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের গণহত্যাকেও সেখানে সংযোগ করতে হবে। সে কথাটা আমরা বলে এসেছি।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে কিছু পর্যালোচনাসহ প্রকাশ হবে। এর মধ্যে কিছু দৃষ্টিভঙ্গিগত ও শাব্দিক চয়নে সবার আলোচনার প্রয়োজন। সেটার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার কাছে সময় চেয়েছেন। তিনি দলগুলোর সময়ক্ষেপণের বিষয়ে লক্ষ রাখতে বলেছেন, যাতে কালবিলম্বও না হয়, আবার যেন দ্রুতগতিতেও না হয়; মাঝামাঝি সময়ে ঐকমত্যে পৌঁছে সুন্দর একটি জিনিস প্রকাশ করতে পারি, সে বিষয়ে সবাই ঐকমত্য হয়েছি।’
বৈঠকে অন্য দলের নেতাদের মধ্যে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে তিন সদস্য, ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমানের নেতৃত্বে দুই সদস্য, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম অংশ নেন। এ ছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ-মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা ও জাতীয় গণফ্রন্টের কামরুজ্জামানও বৈঠকে অংশ নেন।