পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মানেই বিশাল কর্মযজ্ঞ। পাবনার রূপপুরে নির্মীয়মাণ বাংলাদেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের আয়োজন দেখলে সেটি সহজেই অনুমান করা যায়। আবার সেই সঙ্গে রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিও। জাপানের ফুকুশিমা সেটি বিশ্ববাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
তবে এরপরও সবচেয়ে নিরাপদ এবং কম কার্বন নিঃসরণকারী জ্বালানি হিসেবে এখনো পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাস্তব বিকল্প সামনে আসেনি। যদিও বিশাল নির্মাণ বাজেট আর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ও দক্ষতার অপ্রতুলতার কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এই প্রযুক্তি নিতে পারে না।
এই বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এসেছে রোলস-রয়েস, নিউস্কেলের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এবং সংশ্লিষ্ট দেশের অনুমোদনও পেয়ে গেছে তারা। এরা কার্যকর ছোট মডুলার রিঅ্যাক্টর বানিয়ে দেখিয়েছে। তাদের দাবি, এমন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বাসাবাড়িতেও স্থাপন করা যাবে। আর এর জন্য বিশাল নির্মাণযজ্ঞের দরকার নেই। কারণ, মডিউলগুলো লরিতে বহন করা যায়। এগুলো একটা একটা করে জোড়া দিলেই হয়ে যায় পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
মার্কিন নিউক্লিয়ার স্টার্টআপ নিউস্কেল গত বছরের শেষ নাগাদ তাদের মডুলার রিঅ্যাক্টর ডিজাইনের জন্য চূড়ান্ত নিরাপত্তা অনুমোদন পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আরও কয়েকটি কোম্পানি এ ধরনের রিঅ্যাক্টর নিয়ে কাজ করছে। তবে নিরাপত্তা অনুমোদন পাওয়া এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রতিষ্ঠান নিউস্কেল।
নিউস্কেলের ডিজাইনে ক্ল্যাসিক নিউক্লিয়ার ফিশন ওয়াটার রিঅ্যাক্টর প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য এখনো উন্নয়নের কাজ চলছে। সঙ্গে যুক্ত হতে পারে গলিত লবণের মতো প্রযুক্তি। চূড়ান্ত ধাপে উন্নত চুল্লিগুলোতে ফিউশন বিক্রিয়া ব্যবহার করা হবে।
নিউস্কেলের ডিজাইন করা রিঅ্যাক্টরের মূল বৈশিষ্ট্য হলো- এটি মডুলার এবং ক্ষুদ্রাকার। যদিও এটি নতুন ধারণা নয়। কোম্পানির লক্ষ্য, যথাসম্ভব ছোট জায়গায় চুল্লিটি স্থাপন করা এবং ছোট শহর বা একটি কমিউনিটির মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া।
মডুলার রিঅ্যাক্টরের নকশাগুলো বলতে গেলে সাবমেরিনে ব্যবহৃত বহনযোগ্য পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতোই। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র মহাকাশযানে ব্যবহারের চেষ্টাও চলছে।
বর্তমান নকশা অনুযায়ী, প্রতিটি মডিউল থেকে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। নিউস্কেলের পরবর্তী সংস্করণটি হবে ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন।
কোম্পানির মার্কেটিং এবং কমিউনিকেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডায়ান হিউজ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ২০২৩ থেকে ২০৪২ সালের মধ্যে ৬৭৪ থেকে ১ হাজার ৬৮২টি রিঅ্যাক্টর বিক্রির আশা করছেন তাঁরা। তাঁদের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রিঅ্যাক্টর দিয়ে ৮০ গিগাওয়াট সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন ৯৮ গিগাওয়াট। যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান পারমাণবিক সক্ষমতার সরবরাহ আসে মাত্র ১০০টি বড় চুল্লি থেকে। বিদ্যমান প্ল্যান্টগুলো দেশের প্রায় ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জর্ডান, রোমানিয়া, ইউক্রেন এবং অন্যান্য দেশের কোম্পানি এবং ইউটিলিটি পরিষেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এরই মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে নিউস্কেল।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার হিসাবে, কয়েক ডজন মডুলার নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের নকশা নিয়ে কাজ চলছে। এর মধ্যে আর্জেন্টিনা, চীন এবং রাশিয়াতে বেশ কয়েকটি নির্মাণের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
এদিকে গত নভেম্বরের শুরুর দিকে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের একটি কনসোর্টিয়াম রোলস-রয়েসে বিনিয়োগের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। যুক্তরাজ্যে আরও নিরাপদ এবং সবুজ জ্বালানি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তারা মডুলার পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও বিপণন করবে।
রোলস-রয়েস এই কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে ১৯ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড এবং সরকারি অনুদান হিসেবে ২১ কোটি পাউন্ড তহবিল পেয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই কোম্পানি যুক্তরাজ্যে এই খাতে ৪০ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। যেখানে বর্তমানে, যুক্তরাজ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ১৬ শতাংশ আসে পারমাণবিক শক্তি থেকে।
অবশ্য সমালোচকেরা বলছেন, নতুন পরমাণু চুল্লি আর নয়, সবার বরং নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে নজর দেওয়া উচিত।