বার্লিনের একটি সবুজ পার্কিংয়ে ছোট্ট একটি অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। ‘টুমোরো ডট বায়ো’ নামে ইউরোপের প্রথম ক্রায়োনিক্স ল্যাবের পরিবহন এটি। ক্রায়োনিক্সের মাধ্যমে মূলত মৃত্যুর পর কোনো মানুষের মরদেহটিকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা হয়।
এভাবে সংরক্ষিত মরদেহকে ভবিষ্যতে আবারও পুনরুজ্জীবিত করাই জার্মান সেই ক্রায়োনিক্স প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য হলো। এই সেবার জন্য খরচ ধরা হয়েছে ২ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার বেশি।
প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক ক্যানসার গবেষক এমিল কেঞ্জিওরা জানিয়েছেন, ক্যানসারের চিকিৎসায় অগ্রগতি খুব ধীর বলেই তিনি এই নতুন ক্ষেত্র নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তাঁরা এখন পর্যন্ত তিন-চারজন মানুষ এবং পাঁচটি পোষা প্রাণীকে ক্রায়োপ্রিজারভ করেছেন।
এর বাইরে মাসিক চাঁদার মাধ্যমে প্রায় ৭০০ জন ওই কার্যক্রমের সদস্য হিসেবে নিবন্ধন করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি পরিকল্পনা করেছে, ২০২৫ সালের মধ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে তাদের কার্যক্রম বাড়াবে।
এ বিষয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত কেউ মৃত্যুর পর ক্রায়োপ্রিজারভেশনের মাধ্যমে আবারও বেঁচে উঠেছেন এমন নজির নেই। এমনকি এ রকম ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা পুরোপুরি রক্ষা করা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। কিংস কলেজ লন্ডনের নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক ক্লাইভ কোয়েন এই ধারণাকে ‘অবাস্তব’ বলে মন্তব্য করেছেন।
জানা গেছে, এই প্রক্রিয়াটি গ্রহণ করা কোনো মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি হলে ‘টুমোরো ডট বায়ো’ তাদের বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। চিকিৎসকেরা ওই ব্যক্তির মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়ার পরই তাঁর মরদেহটির ক্রায়োপ্রিজারভেশন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এভাবে প্রথমেই সেই মরদেহটিকে সাবজিরো তাপমাত্রায় শীতল করা হয় এবং ক্রায়োপ্রোটেকটিভ ফ্লুইড দিয়ে শরীরের পানি প্রতিস্থাপন করা হয়। এটি করা হয় যেন, শরীরের পানি বরফ হয়ে কোনো টিস্যু ধ্বংস না হয়ে যায়।
এরপর সেই শরীরটিকে মাইনাস ১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শীতল করে সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত একটি স্টোরেজ ইউনিটে সংরক্ষণ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির আশা, ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির মাধ্যমে মৃত মানুষকেও আবার বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হবে।
এখন প্রশ্ন হলো—এভাবে কি সত্যিই অমরত্ব পাওয়া সম্ভব নাকি কেবলই শূন্য প্রতিশ্রুতি? ক্রায়োনিক্স নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ এবং এই পদ্ধতির সমালোচনাও রয়েছে অনেক। তবে এই বিষয়ে টুমোরোর প্রতিষ্ঠাতা কেঞ্জিওরা বলেন, ‘মৃত্যুর পর কেউ ফিরে আসতে পারবে, এই ধারণা অনেকের কাছেই উদ্ভট মনে হয়। এখনকার অনেক চিকিৎসা পদ্ধতিকেও এক সময় সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে।’
এদিকে ক্রায়োনিক্স প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত যেসব সাফল্যের দেখা পাওয়া গেছে, সেগুলো এখনো প্রাথমিক স্তরেই সীমাবদ্ধ। যেমন—রাউন্ডওয়ার্ম বা ইঁদুরের কিডনি সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবিত করার কিছু সফল উদাহরণ দেখা গেছে ইতিপূর্বে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কার্যকর হবে কি না, তা এখনো প্রমাণিত হয়নি।
বর্তমানে ক্রায়োনিক্স নিয়ে গবেষণার যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অনেকে এটিকে ‘ভ্রান্ত ধারণা’ বলে মনে করেন। কিংস কলেজ লন্ডনের নিউরোসায়েন্স প্রফেসর ক্লাইভ কোয়েন বলেন, ‘মৃত্যুর পর কোষ দ্রুত নষ্ট হতে শুরু করে এবং ক্রায়োপ্রিজারভেশন থেকে উষ্ণায়নের সময় এই ক্ষতি আরও বাড়বে।’
ক্রায়োনিক্সের নৈতিক এবং আর্থিক দিকগুলোও বিতর্কিত। ‘টুমরো ডট বায়ো’ তাদের ক্লায়েন্টদের দেহ সুইজারল্যান্ডের একটি অলাভজনক ফাউন্ডেশনে সংরক্ষণ করে। তবে কয়েক শতাব্দী পর এসব দেহ কীভাবে পরিচালিত হবে, তা একটি অনিশ্চিত প্রশ্ন।
মরদেহ সংরক্ষণের জন্য উচ্চ খরচও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। তবে কেঞ্জিওরা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘যারা ৮৫ বছর বয়সে দ্বিতীয় ইয়ট কিনতে ২ লাখ ডলার ব্যয় করেন, তারা চাইলে এই বিনিয়োগও করতে পারেন।’
‘টুমোরো ডট বায়ো’ আশা করছে, ২০২৮ সালের মধ্যে মস্তিষ্কের স্মৃতি এবং পরিচয়ের গঠন সংরক্ষণ সহ পুনরুজ্জীবনের প্রযুক্তি যথেষ্ট উন্নত হবে। তবে এটি বাস্তবে কতটা সম্ভব হবে, তা এখনই বলা কঠিন।
কেঞ্জিওরা বলেন, ‘ক্রিমেশনের তুলনায় এই প্রক্রিয়ার সফলতার সম্ভাবনা বেশি। আর কিছু না হোক, এটি চেষ্টা করার মতোই।’