Ajker Patrika
হোম > বিজ্ঞান

পৃথিবী থেকে দেড় হাজার কোটি মাইল দূরে মহাশূন্যে যেভাবে গেল বাংলা ভাষা

প্রমিতি কিবরিয়া ইসলাম

পৃথিবী থেকে দেড় হাজার কোটি মাইল দূরে মহাশূন্যে যেভাবে গেল বাংলা ভাষা
গোল্ডেন রেকর্ডের মোড়ক বানানো হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম ও ইউরেনিয়াম-২৩৮ আইসোটোপ দিয়ে। ছবি: নাসা

আমাদের সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবী থেকে ১৫ বিলিয়নের (দেড় হাজার কোটি) মাইলেরও বেশি দূরে আন্তনাক্ষত্রিক মহাশূন্যে পাড়ি জমিয়েছে বাংলা ভাষা! এটি সম্ভব হয়েছে নাসার দুই মহাকাশযান ভয়েজার–১ এবং ভয়েজার–২–এর কল্যাণে। কারণ, এদের সঙ্গী হয়েছে মানবসভ্যতার এক অমূল্য রত্ন—‘গোল্ডেন রেকর্ড’, যেটিতে গ্রথিত আছে পৃথিবীর সংস্কৃতি, ভাষা, সংগীত এবং সভ্যতার বাছাইকৃত নমুনা। এই অমূল্য দলিল মহাকাশে অনন্তের পথে যাত্রা করেছে। এসব নমুনার মধ্যে বাংলা ভাষাও রয়েছে।

মহাকাশযান দুটির যাত্রা শুরু হয় ৪৭ বছর আগে, ১৯৭৭ সালে। এগুলোতে রয়েছে গোল্ডেন রেকর্ড নামের গ্রামোফোন রেকর্ড। তামার ওপরে সোনার প্রলেপ দিয়ে এই রেকর্ডটি বানানো হয়েছে। আর এর মোড়ক বানানো হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম ও ইউরেনিয়াম–২৩৮ আইসোটোপ দিয়ে। নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধাতব চাকতি কোটি কোটি বছর অক্ষত থাকবে।

গোল্ডেন রেকর্ড শুধু একটি সংগীতের রেকর্ড নয়, এটি পৃথিবীর মানবসভ্যতার নিদর্শন। পৃথিবী গ্রহের সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের একটি অমূল্য দলিল এটি। এতে নানা প্রান্তের সংগীত, ছবি, প্রাণীর ডাক এবং প্রাকৃতিক শব্দের রেকর্ড রয়েছে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে বিখ্যাত সংগীত, যেমন—বিটলসের ‘হ্যালো, গুডবাই’, তেমনি দক্ষিণ আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী ড্রামের বিট, পৃথিবীর নানা প্রাণীর ডাক—এমনকি সমুদ্রের গর্জনও।

তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনটি হলো মানুষের ভাষার বৈচিত্র্য। গোল্ডেন রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পৃথিবীর ৫৫টি ভাষার সম্ভাষণ, যার মধ্যে রয়েছে—ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, আরবি, চীনা মান্দারিন, হিন্দি, উর্দুসহ আরও অনেক ভাষা। এমনকি দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী ভাষারও রয়েছে এটিতে।

এর মধ্যে বাংলা ভাষার উপস্থিতি একটি গৌরবের বিষয়। আমাদের মাতৃভাষায় একটি ছোট্ট বার্তা রয়েছে, যা ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীর কাছে আমাদের অস্তিত্ব জানান দিতে পারে এটি।

গোল্ডেন রেকর্ডে সম্ভাষণটি শুরুর এক মিনিট আট সেকেন্ডের মাথায় বাংলা ভাষায় সম্ভাষণ শোনা যাবে। সেখানে বলা হয়, ‘নমস্কার, বিশ্বে শান্তি হোক।’ এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজনীতিবিদ সুব্রত মুখার্জির কণ্ঠ।

২০১৫ সালের জুলাই মাসে এই রেকর্ডের অডিও অংশটি মিউজিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম সাউন্ড ক্লাউডে প্রকাশ করেছে নাসা।

গোল্ডেন রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত এমন আরও কয়েকটি ভাষার সম্ভাষণ হলো—

হিন্দি: পৃথিবীবাসীর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা।

নেপালি: পৃথিবীবাসীর পক্ষ থেকে আপনাদের শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ কামনা করছি।

ইংরেজি: পৃথিবীর শিশুদের পক্ষ থেকে হ্যালো।

আরবি: নক্ষত্ররাজির মধ্যে থাকা আমাদের বন্ধুদের প্রতি শুভেচ্ছা। একদিন আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে পারব, আমরা এই আশা করি।

ক্যানটোনিজ (চীনা ভাষার একটি ধরন) : হাই, কেমন আছেন? আপনাদের শান্তি, সুস্থতা ও সুখ কামনা করি।

প্রাচীন ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে—

আক্কাদিয়ান: সবাই খুব ভালো থাকুক।

আরামাইক: সালাম বা শান্তি।

হিব্রু: সালম বা শান্তি।

ভয়েজার রেকর্ডের বিষয়বস্তু নির্বাচন করেছিল নাসার একটি কমিটি, যেটির প্রধান ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ড. কার্ল সাগান। ড. সাগান এবং তাঁর সহকর্মীরা ১১৫টি ছবি এবং প্রকৃতির বিভিন্ন শব্দ সংগ্রহ করেছিলেন, যেমন—সমুদ্রের ঢেউ, বাতাস, বজ্রপাত, পাখি, তিমি এবং অন্যান্য প্রাণীর ডাক। এরপর তাঁরা বিভিন্ন সংস্কৃতি ও যুগ অনুযায়ী সংগীতও যুক্ত করেন। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এবং জাতিসংঘের মহাসচিব কার্ট ওয়াল্ডহেইমের মুদ্রিত বার্তাও যোগ করেছিলেন।

বিজ্ঞানী কার্ল সাগান এবং তাঁর সহকর্মীরা বিশ্বাস করেছিলেন যে যদি কখনো মহাবিশ্বের কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী এই রেকর্ডটি পায়, তাহলে তারা এই রেকর্ডের মাধ্যমে পৃথিবী এবং মানব প্রজাতি সম্পর্কে জানতে পারবে।

গোল্ডেন রেকর্ডে কিছু সাদা-কালো, কিছু রঙিন ছবি রাখা হয়েছে। যেমন—সুপারমার্কেটে বাজার করতে যাওয়া নারীর ছবি, মানুষ কত রকম ভঙ্গিতে খাওয়াদাওয়া করে তার ছবি। মানুষের ছবিসহ বিভিন্ন প্রাণী, কীটপতঙ্গ, গাছপালা, প্রাকৃতিক দৃশ্য ইত্যাদি। আবার কিছু বৈজ্ঞানিক ধারণার ছবিও সঙ্গে দেওয়া হয়েছে।

প্রতিটি রেকর্ড অ্যালুমিনিয়াম জ্যাকেটের রক্ষাকবচে সংরক্ষিত। এর সঙ্গে রয়েছে একটি কার্টিজ এবং একটি সুঁই। রেকর্ডটি কীভাবে বাজাতে হবে সেটির নির্দেশনা সংবলিত একটি চিত্রও দেওয়া হয়েছে।

ভয়েজার–১ ও ভয়েজার–২–এর প্রাথমিক মিশন ছিল—বৃহস্পতি ও শনি গ্রহের প্রকৃতি অনুসন্ধান করা, যা এরা যথেষ্ট সফলভাবে সম্পন্ন করেছিল। মহাকাশযান দুটি শনি গ্রহের বলয় এবং বৃহস্পতির চাঁদ আইওয়ের চিত্র ও তথ্য পৃথিবীতে পাঠায়। ভয়েজার–১ বৃহস্পতির চারপাশে একটি সরু বলয় এবং বৃহস্পতির দুটি নতুন চাঁদ থিবি ও মেটিস আবিষ্কার করেছে। এটি শনির পাঁচটি নতুন চাঁদ এবং একটি নতুন বলয়ও পেয়েছে, যা ‘জি–রিং’ নামে পরিচিত।

১৯৭৭ সালের ২০ আগস্ট ভয়েজার–২ এবং ৫ সেপ্টেম্বর ভয়েজার–১ উৎক্ষেপণ করা হয়। ১৯৭৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর ভয়েজার–১ ভয়েজার ২–কে অতিক্রম করে যায়। মহাকাশযানটি মানুষের তৈরি প্রথম বস্তু, যা আমাদের সৌরজগৎ এবং সৌরবলয় ছাড়িয়ে আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশে প্রবেশ করেছে।

বর্তমানে, ভয়েজার–১ পৃথিবী থেকে ১৫ বিলিয়ন (দেড় হাজার কোটি) মাইলেরও বেশি দূরে অবস্থান করছে। আর এর সঙ্গী ভয়েজার–২ পৃথিবী থেকে ১২ বিলিয়ন (১ হাজার ২০০ কোটি) মাইলেরও দূরে রয়েছে। এদের যাত্রা থেমে নেই। নিয়মিত তারা পৃথিবীতে তথ্য–উপাত্ত পাঠাচ্ছে। তবে আরও দূরে চলে গেলে একসময় আর পৃথিবীতে তাদের পাঠানো কোনো তথ্য এসে পৌঁছাবে না। নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভয়েজারের সঙ্গে পৃথিবীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও কোনো একসময় বুদ্ধিমান ভিনগ্রহের প্রাণীরা এর সন্ধান পেলে গোল্ডেন রেকর্ডে রক্ষিত নিদর্শনগুলো দেখে জানতে পারবে নীল গ্রহে মানবসভ্যতার অস্তিত্বের কথা।

তথ্যসূত্র: নাসা ডট কম, স্ল্যাশগিয়ার, নিউজউইক

১১ হাজার বছর পর আবার বরফে ঢেকে যাবে পুরো পৃথিবী: গবেষণা

পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য থেকে ব্যাটারি, রিচার্জ ছাড়াই চলবে বহু বছর

তীব্র ঠান্ডায়ও মেরু ভালুকের লোমে বরফ জমে না যে কারণে

ডুমস ডে ভল্টে যুক্ত হলো আরও ১৪ হাজার ফসল বীজ

গভীর মহাকাশে মূল্যবান ধাতুর সন্ধানে যাচ্ছে মহাকাশযান ওডিন

এক সারিতে আসবে সৌরজগতের ৭ গ্রহ, বিরল দৃশ্য দেখবেন যেভাবে

প্লুটো দিবস আজ, গ্রহের মর্যাদা হারালেও আগ্রহের কেন্দ্রে

উদ্ভিদের ক্ষত সারাবে ব্যাকটেরিয়ার সেলুলোজ ব্যান্ডেজ: গবেষণা

পৃথিবীতে ফিরছেন মহাকাশে আটকে পড়া দুই নভোচারী, তারিখ জানাল নাসা

২০৩২ সালে পৃথিবীতে গ্রহাণুর আঘাত হানার সম্ভাবনা বাড়ছে