দক্ষতা থাকলে এআইয়ের উৎকর্ষতার সময়েও চাকরি হারানোর আশঙ্কা কম। মানুষের সৃজনশীলতা, মৌলিক ভাবনা বিশ্লেষণ করতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আরও দীর্ঘদিন লাগবে।
বিশ্বজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। এআই ব্যবহার করে বহুদিন ধরেই যন্ত্রসভ্যতা বিকশিত হচ্ছে। সমকালে চ্যাটজিপিটি সূত্রে এআই আবার আলোচনার পাদপ্রদীপে। অতিসম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত সংবাদ পাঠক দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর নানা দেশে। এই সংবাদ পাঠকদের নামগুলো চিত্তাকর্ষক। ইন্ডিয়া টুডের এপ্রিলে যাত্রা শুরু করা পাঠকটির নাম সানা।
ওডিশা টিভিতে, ভারতের প্রথম আঞ্চলিক এআই নিউজ প্রেজেন্টারের নাম লিসা। ইন্দোনেশিয়ার টিভি ওয়ান চ্যানেল তিন মাসে দুজনকে এনেছে। চীন এ ব্যাপারে পথিকৃৎ। বিষয়টা খুলে বলা যাক।
রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থা সিনহুয়ায় ভার্চুয়াল সংবাদ পাঠকের দায়িত্ব ছিল টানা ২৪ ঘণ্টা কাজ করা। খবর উৎপাদনের খরচ কমানো। ২০১৮ সালে চীনের এই পদক্ষেপ সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে একধরনের বিস্ময় তৈরি করে, সঙ্গে চাঞ্চল্য। রক্ত-মাংসের সংবাদ উপস্থাপকের ভূমিকা নিয়ে সংশয়ে পড়ে যায় সংশ্লিষ্ট মহল। বছর চারেক আগে ‘দ্য জার্নাল’ পত্রিকার রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান ফ্রান্সেসকো মারকোনি নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, এআই এখন অতিপ্রয়োজনীয়। ‘আমি ধারণা করি, সাংবাদিকতার একাধিক ক্ষেত্র অদূর ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত হবে।’ মারকোনি ২০১৯ সালে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেন। চ্যাটজিপিটির যুগে তাঁর এ কথা
ফলে গিয়েছে।
পৃথিবীজুড়ে নিউজরুমগুলো প্রযুক্তির সঙ্গে কাজের পরিবেশ ও গতি কেমন করে মেলাবে, সেসব নিয়ে ভাবছে। এশিয়ায় যেমন এআই সংবাদ উপস্থাপক দিব্যি নানা দেশে নিউজ বুলেটিন পড়ছে। সংস্কৃতি ও ভাষার ক্ষেত্রেও বক্তব্য দিচ্ছে। ইন্ডিয়া টুডের সংবাদ পাঠক সানা, একটু আগেই যার কথা পড়লাম আমরা, প্রাইম টাইমে সম্পূর্ণ ফরাসিতে একটি নিউজ রিপোর্ট পড়ার অংশ হয়ে ভারতে সংবাদ প্রচারের মাইলফলক হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দ্বীপরাষ্ট্র, দেশটির সর্বাধিক প্রচারিত টিভি চ্যানেল টিভি ওয়ান তিনটি ভার্চুয়াল প্রেজেন্টার এনেছে। নাদিরা, শাসিয়া ও ভূমি। ইন্দোনেশিয়ার নানা জাতি বৈচিত্র্যের সঙ্গে মিলিয়ে এই সংবাদ পাঠকদের অবয়ব নির্বাচিত হয়েছে। যদিও দেশটির সংবাদমাধ্যমের দর্শক জরিপ অনুযায়ী, ছবি ও তথ্য উচ্চারণের সিনক্রোনাইজেশনে তারা এখনো সড়গড় হয়নি। কিন্তু প্রযুক্তি যেহেতু ক্রমপ্রসারিত বিষয়, দ্রুতই এই সমস্যা কাটবে বলে দর্শকদের বিশ্বাস।
তাইওয়ানের এফটিভি নিউজ এআই প্রেজেন্টারের মাধ্যমে দুই মিনিটে ওয়েদার ফোরকাস্ট প্রচার করেছে জুলাইয়ের ৩ তারিখে। এখনো নাম ঠিক হয়নি তার। ছয় মাস ধরে ওখানকার প্রযুক্তিবিদেরা এর জন্য খেটেছেন। এআইজিসি, অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স গ্লোবাল কোম্পানি টেকনোলজি ব্যবহার করে মানুষের ইমেজের বাস্তবপ্রতিম ছবি উৎপাদন করা হচ্ছে। নাম ঠিক না হওয়া এই সংবাদ পাঠক পাঠের ধরন, বিরতি নেওয়া, মানুষের শারীরিক ভঙ্গির অনুসরণ এবং সামগ্রিকভাবে সংবাদ উপস্থাপনে দ্রুত উন্নতি করছে।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম আর্টিফিশিয়াল সংবাদ পাঠক এনেছে কুয়েত। ফেদা নামের এই পাঠক কুয়েত নিউজের টুইটার অ্যাকাউন্টে আবির্ভূত হয়ে সাড়া ফেলেছে। নিউজরুমে এআই ব্যবহারের নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কুয়েতের সংবেদনশীল দর্শক। মালয়েশিয়ার নেতৃস্থানীয় সংবাদ সংস্থা অ্যাস্ট্রো আওয়ানি মে মাসে দুজন এই প্রযুক্তির সংবাদ পাঠককে মানুষের সামনে এনেছে। একজন জুন, তাদের চ্যানেল ফাইভ জিরো ওয়ানে আবির্ভূত হয়েছে বিকেলের সংবাদ প্রচারে।
অন্যজন মনিকা, দেখতে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের মতো, প্রতি রাতে আওয়ানিদের টিভি টক শোতে উপস্থিত হচ্ছে। অ্যাস্ট্রো আওয়ানির প্রধান সম্পাদক আশ্বাদ ইসমাইল জানিয়েছেন, জুন আর মনিকার মতো এআইয়ের প্রতিদিনের উন্নতি অতিগুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিশ্চিত করেছেন, মানবীয় মেধার প্রতিস্থাপন ঘটাতে এদের উপস্থিতি কোনো চ্যালেঞ্জ নয়; বরং তারা একক মানুষের সক্ষমতা বাড়াবে। সংবাদের গুণগত মান রক্ষায় ভূমিকা রাখবে।
আমাদের দেশেও সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল এআই সংবাদ পাঠক এনেছে। তার নামটি সুন্দর, অপরাজিতা। প্রশ্ন উঠেছে, পৃথিবীজুড়ে এআই সংবাদ পাঠক সংবাদমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের প্রতিস্থাপক হয়ে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হবে না তো! আশঙ্কা অমূলক বলেই মনে হয়। দক্ষতা যেকোনো চাকরির পূর্বশর্ত। দক্ষ পরিশ্রমী কর্মী, তিনি যেকোনো ক্ষেত্রেরই হন, এআই উৎকর্ষের যুগেও কাজ হারাবেন না। মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত কারিগরি ও সৃজনশীল দক্ষতা তৈরি করতে, মৌলিক ভাবনা ভাবতে, বিশ্লেষণ করতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আরও দীর্ঘদিন লাগবে। ফলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
তথ্যসূত্র: টেকওয়ার এশিয়া
অলংকরণ: মীম রহমান