সে দাঁড়িয়ে আছে ১০ বছর ধরে। তাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার ব্যাপারে বাবা–মায়েরা তৎপর থাকলেও, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই আছে অবহেলায়। বঞ্চনা হয়েছে তার সাথি। এখন বাবা–মাও তাকে পৃথিবীতে আনার দায় স্বীকার করছে না। উল্টো তাকে নিয়ে শুরু হয়েছে ফুটবল খেলা। কেউ বলছে ও এনেছে, আর ‘ও’ বলছে সন্তান আমার নয়!
এমনই এক ‘বিরূপ’ পরিস্থিতিতে পড়েছে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের একটি সেতু। ঠিক খালের মাঝখানে সেতুটি, তাতে ওঠা-নামারও উপায় নেই। একেবারে অস্পৃশ্য যাকে বলে। কেউ নাকি এখন সেতুটির দায়িত্বও নিতে রাজি না। এ দুঃখে সেতুটি মর্মাহত। বছরের পর বছর ধরে এসব নিয়ে ‘মন খারাপ’ থাকায় সেতুটির স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে পড়ছে বলে অনেকে দাবি করছেন। তাদের ধারণা, এ কারণেই দিন দিন জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে পড়ছে সেতুটি।
আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ধনপুর বাজারের পূর্ব-দক্ষিণে কাটাখালী খালে ১০ বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সড়কহীন সেতুটি। অপরিকল্পিত নির্মাণ ও সংযোগ সড়ক না থাকায় নির্মাণের পর থেকে সেতুটি কোনো কাজে আসছে না। এ সেতুর দায়িত্বও নিতে চায় না কোনো দপ্তর। স্থানীয়রা বলছেন, বাঁশের সাঁকো বা নৌকা দিয়ে পার হতে হয় খাল। প্রায় ১০ বছর আগে খাল পারাপারে সড়কের কয়েক শ মিটার দক্ষিণে, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অধিদপ্তর ৩০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটি নির্মাণ করে। স্থানীয় বাধা ও পরামর্শ উপেক্ষা করে নির্মিত সেতুটি একদিনও মানুষের ব্যবহারে আসেনি।
এদিকে এমন একটি সেতু খালের মাঝখানে কেন ‘পয়দা’ করা হলো এবং কারা উদ্যোগী ভূমিকা নিল—সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই বেরিয়ে আসে বিভ্রান্তির ‘বেগুনি’ মেঘ। খবরে প্রকাশ, মূল সড়কের বাইরে এই সেতু নির্মাণ ও দীর্ঘদিন সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করার কারণ জানতে চাইলে ইটনা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সেতুটি ত্রাণ মন্ত্রণালয় বা পিআইও নির্মাণ করেনি।’ একই প্রশ্নে ইটনা উপজেলা প্রকৌশলী জানিয়ে দিয়েছেন, ‘কাটাখালী খালের সেতুটি এলজিইডি বিভাগের নয়।’ বুঝুন এবার! খালের মাঝখানে এমন একটি ‘অনিন্দ্য-সুন্দর’ সৃষ্টিকে কেউ স্বীকারই করছে না! এ দেশে কি তবে সৃষ্টির কোনো দাম নেই?
এমতাবস্থায় সেতুটি ‘চরম হতাশ’ হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেউ কেউ বলছেন, ১০ বছরেই কেউ আর সেতুটি তৈরির দায়িত্ব কাঁধে নিচ্ছে না। যদি কারও কাঁধে ব্যথা থাকে, তবে তার চিকিৎসায় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু তাই বলে এত বড় একটি স্থাপনার দায়িত্ব নেওয়া যাবে না, এ কেমনতর কথা? এতে কাঁধের অপমান হয় কি-না, সেই প্রশ্নও উঠে গেছে।
এদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, কেন এই সেতু বানানো হয়েছিল, তা তাঁরা জানেন না। সেতুটি নাকি একদিনও মানুষের কাজে লাগেনি! সরকারি টাকা নষ্ট করারও অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা। যদিও সচেতন ও বর্তমান ‘ট্রেন্ড’ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অনুগত নাগরিকসমাজ মনে করছে, এমনটা ‘মন খারাপ’ হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। মানুষের কাজে লাগেনি বলেই সেতুটির উপযোগিতা নষ্ট হতে পারে না। সেতুটি নিশ্চয়ই কারও না কারও কাজে অবশ্যই লেগেছে। সুতরাং এভাবে ‘নিন্দা-মন্দ’ যারাই করবে, তাদের হীন উদ্দেশ্য আছে বলে ধরে নিতে হবে।