দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক হারে বাড়ছে। মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। চোখে সরষে ফুল দেখছেন অনেকেই। বিশেষত নিম্নবিত্ত মানুষ আছেন শাঁখের করাতের ওপর বসে। একদিকে করোনা, অন্যদিকে অভাব দুই–ই কাটছে তাদের। বলে রাখা ভালো–যারা বলেন, দেশে কেউ দায়িত্বশীল নেই, তাদের মুখে ছাই ছিটাতেই বুঝে তাঁরা মুখের সব আগল খুলে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে পদাধিকারবলেই সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
অভয়বাণী
দেশে প্রথম প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের আগে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি সচিবালয়ে বসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, ‘এই ভাইরাস বাংলাদেশে আসবে না। এটি যাতে বাংলাদেশে আসতে না পারে, এ জন্য দেশের সব বন্দরে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বার্তা পাঠানো হয়েছে।’
উদ্দেশ্য সৎ ছিল নিশ্চয়। করোনা আতঙ্কে দিন কাটানো গোটা বিশ্বের সামনে নজির সৃষ্টি করতেই বুঝি তিনি এ কথা বলেছিলেন। আশ্বস্ত করতে চাইলেন মানুষকে। কিন্তু মানুষ? ভুল বুঝল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু দুরাচারী রীতিমতো ট্রল শুরু করল। এখানে থামলেও হতো। জেগে উঠল সংগঠনগুলো। বক্তৃতা হলো, বিবৃতি হলো। এমনকি মানবন্ধনও হলো করোনা নিয়ে। বিশ্বের ইতিহাসে এটাই প্রথম কিনা খুঁজে দেখবেন বিশেষজ্ঞরা।
বাস্তবতা:
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তাবৎ সু–উদ্দেশ্যকে কাঁচকলা দেখিয়ে করোনা ঠিকই চলে এল দেশে। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হলো। বাকিটা ইতিহাস—যা এখনো চলমান।
গবেষকের ভূমিকা
মানুষের আতঙ্ক কমাতে কী না করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এমন মন্ত্রী হয় না। সেই সত্যযুগে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু এই যুগে এমন মন্ত্রী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের পর হাল না ছেড়ে দ্রুততম সময়ে একটি গবেষণা করলেন তিনি। গেবষণার ফলও জানিয়ে দিলেন তদ্নগদ। পরদিন ৯ মার্চ সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, ‘করোনাভাইরাস মারাত্মক রোগ নয়, ছোঁয়াচে।’
ভাগ্যিস আমাদের একটা সচিবালয় ছিল।
বাস্তবতা:
করোনা মারাত্মক একটি ভাইরাস। একই সঙ্গে ছোঁয়াচেও। করোনা যে প্রানসংহারী তা তো পৃথিবীর ২৯ লাখের বেশি মানুষ মরে প্রমাণ করেছে।
প্রস্তুতিতে বিশ্বসেরা
গত বছরের ২৩ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জাহিদ মালেক বলেন, করোনা মোকাবিলায় কেউ আগে থেকে প্রস্তুত থাকে না। বাংলাদেশ তিন মাস আগে থেকে প্রস্তুত ছিল।
বাস্তবতা
তিন মাস আগে তো দূরের কথা; বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশে এখনো বিজ্ঞানভিত্তিক প্রস্তুতির কোনো লক্ষণ নেই। সক্ষমতাও প্রশ্নবিদ্ধ। এখানে প্রতিদিন যে হারে পরীক্ষা করানো হয়, তাতে সবার পরীক্ষা সম্পন্ন হতে পাঁচ–সাত বছর লাগবে।
পরিসংখ্যানবিদ
এত কিছুর পরও যখন কিছুতে কিছু হলো না, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী পরিসংখ্যানবিদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। গত বছরের ২৯ মার্চ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে তিনি বললেন, ‘আমাদের প্রায় ৫০০ ভেন্টিলেটর আছে। অনেক বড় বড় দেশেও এত ভেন্টিলেটর থাকে না। ইউরোপ, আমেরিকার অবস্থা কী রকম, সেটা আপনারা জানেন।’
বাস্তবতা
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্যমতে, ৩২ কোটি জনগণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার ভেন্টিলেটর রয়েছে। আর ব্রিটিশ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এনএইচএসের হিসাবমতে, সাড়ে ছয় কোটি মানুষের বিপরীতে যুক্তরাজ্যে ভেন্টিলেটর রয়েছে প্রায় ছয় হাজার। জার্মান সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, দেশটির আট কোটি জনসংখ্যার জন্য রয়েছে ২৫ হাজার ভেন্টিলেটর। আগামী বছরের মধ্যে আরও ১০ হাজার ভেন্টিলেটর তৈরির জন্য স্থানীয় একটি কোম্পানিকে বলেছে দেশটির সরকার।
এ ছাড়া কানাডায় ৪ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে ৫ হাজার, ফ্রান্সের সাড়ে ৬ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে ভেন্টিলেটর রয়েছে ৬ হাজার ৬৫টি।
স্বাস্থ্যখাতে নতুন দিগন্তের উন্মোচন
করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত বছরের জুনে যখন গোটা দেশ তটস্থ, তখন আবারও ত্রাতা হিসেবে সামনে এলেন জাহিদ মালেক। দুর্বার এ স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে বলেন, ‘ভেন্টিলেটরের কোনো প্রয়োজনই নেই। ভেন্টিলেশনে যারা গেছেন, প্রায় সবাই মৃত্যুবরণ করেছেন।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন নতুন তত্ত্বের পর বেরসিক জনতা নামল সমালোচনায়। এ দেশের গুণীর কদর কে কবে করেছে?
বাস্তবতা
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে বিভ্রান্ত মানুষকে সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত করতে অনেক বিশেষজ্ঞ বললেন, অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম এবং নিউমোনিয়াতে চলে যাওয়া রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটর প্রয়োজন।
জ্যোতিষবিদ্যা
শুধু মানুষের কথা ভেবে আামাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কত বিদ্যাই না রপ্ত করেছেন! আগস্ট নাগাদ তাঁর জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রভূত দখলের প্রমাণ পেল দেশবাসী। গত ১৫ আগস্ট মহাখালীর বিসিপিএস মিলনায়তনে জাহিদ মালেক মন্তব্য করেন, ‘ভ্যাকসিন লাগবে না। বেশি দিন লাগবে না; বাংলাদেশ থেকে করোনাভাইরাস চলে যাবে।’
এই বক্তব্যের পর দেশের বহু প্রথিতযশা জ্যোতিষবিদ বাপ–দাদা থেকে পাওয়া জ্ঞানের চুলোয় আগুন দিয়ে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন বলে অবিশ্বস্ত একটি সূত্রে জানা গেছে।
বাস্তবতা:
জনস্বাস্থ্যবিদেরা এই বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক’ আখ্যা দিয়ে বললেন, ‘বিজ্ঞানের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞান বলছে, করোনা নিয়ন্ত্রণের দুটো উপায়। একটি ভ্যাকসিন। আরেকটা হল বিশ্ব স্বাস্থ্র সংস্থার নির্দেশনার সব পর্যায়ে প্রয়োগ।
দেশপ্রেমের নিদর্শন
স্বাস্থ্যমন্ত্রী নতুন বছরের প্রথম মাসটি কীভাবে যেন চুপ থাকলেন। নিশ্চয় বড় কোনো সংকট ছিল। কিন্তু নীরবতা দীর্ঘ হলো না। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘হোয়াট বাংলাদেশ থিংকস টুডে, ইউএসএ থিংকস থ্রি মান্থস লেটার।’
বলার অপেক্ষা রাখে না দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়েই তিনি এমন কথা বলেছেন। আর বাংলাদেশের এমন অর্জনের কথা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতেই বেছে নিয়েছেন এ যুগের আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিকে। ভাষার মাস, তাতে কী।
বাস্তবতা
না বললেও চলে যে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্য সত্য নয়। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহু বিবেচনাতেই ঢের পিছিয়ে রয়েছে।
শেষ কথা
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এমন পারফর্ম্যান্সে বেশ চাপে পড়ে গিয়েছিলেন অন্যরা। মাইক্রোফোন খুঁজে কে কী বলবেন, তা নিয়ে একটা হুজ্জত লেগে গিয়েছিল নিশ্চয়। অনেকে অনেক কথা বলেছেনও, কিন্তু তেমন মার্কেট পাননি। এ অবস্থায় প্রধান সেনাধ্যক্ষ হিসেবে সামনে এলেন ওবায়দুল কাদের। সরকারের জ্যেষ্ঠ এই মন্ত্রী মাঠে নেমেই ছক্কা মারলেন। দেশবাসীর মনোবল চাঙা করতে গত বছরের মার্চে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী।’
বাস্তবতা
কতটা শক্তিশালী, তা এখন দিনে ৮০–পেরোনো মৃত্যু দিয়েই আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝছি। তবে সবাই যে বুঝছে না, তা লোকেদের শপিংমল, বাজার, প্রমোদ ভ্রমণে প্রমাণ। অনেকে বেশ সচেতন হয়ে থুতনিতে মাস্ক লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সে অবস্থায় কেউ পাকড়াও করলে মিষ্টি করে হাসছেন। এই দুরন্ত সাহসীদের সাহস জুগিয়ে চলা মন্ত্রীবর্গকে সালাম ঠোকা ছাড়া আর কী করার আছে।