বাদুড়ের চেহারাটাই এমন যে একে দেখে সাধারণ মানুষের ভালো লাগার কোনো কারণ নেই। তারপর আবার কল্পকাহিনিতে ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে বাদুড়ের যোগ, আর ইদানীং নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব—সব মিলিয়ে একে ঘিরে রীতিমতো একটা ভীতি কাজ করে অনেকের মনেই। তবে আশ্চর্য হলেও সত্যি, অনেকেই আবার ভালোবেসে এই প্রাণীটির আদর-যত্ন করেন, অসুস্থ হলে সেবা করেন। এ ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে অস্ট্রেলিয়ার টোলগা ব্যাট হসপিটাল।
অস্ট্রেলিয়ার আথার্টনে এই হাসপাতাল। সেখানে গেলে আপনি বুঝতে পারবেন বিড়াল-কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণীর বাচ্চাদের মতো বাদুড়ের ছানারাও অনেক আদুরে।
ফ্রুট ব্যাট বা ফলখেকো বাদুড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির বাদুড়ের বাচ্চাদের হাসপাতালটিতে আনা হয় যখন পরজীবী কীট আঁটুলিতে আক্রান্ত হয়ে এদের শরীরের কিছু অংশ বা গোটা শরীরটাই অবশ হয়ে যায়। আবার মা মারা গিয়েছে অথবা এত অসুস্থ যে খাওয়ানোর অবস্থায় নেই এমন বাচ্চাদেরও আনা হয় এখানে।
জেনি ম্যাকলিন এই টোলগা বেট হসপিটালের প্রতিষ্ঠাতা। জেনির ইটের দালানটিই সম্প্রসারিত হয়ে একপর্যায়ে পরিণত হয় বাদুড়ের হাসপাতালে। ব্রিসবেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে আথার্টনে এসে ফিজিওথেরাপির একটি ব্যবসা শুরু করেছিলেন জেনি। এ সময়ই আঁটুলিতে আক্রান্ত হয়ে শরীর অবশ হয়ে যাওয়া প্রচুর বাদুড়ের খোঁজ পেতে থাকেন জেনি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০-এর দশকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাদুড়দের এই হাসপাতাল। এখন ৬০-এ পা দেওয়া জেনি স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে বাদুড়দের সেবা চালিয়ে যাচ্ছেন। শুনে অবাক হবেন প্রতি বছর প্রায় ১২০০ বাদুড় নিয়ে কাজ করেন তাঁরা।
হাসপাতালে আনা বাদুড়দের প্রতিটিকে এক একটি নাম দেওয়া হয়, যেন এর অবস্থার উন্নতি লিপিবদ্ধ ও নজরদারি করা সহজ হয়। একই সময়ে হাসপাতালে অনেক বাদুড়ছানা থাকে, এভাবে নির্দিষ্ট নাম থাকায় দায়িত্বে থাকা স্বেচ্ছাসেবকের কাজটাও অনেক সহজ হয়।
এখানে আনা বেশির ভাগ বাদুড়ের বাচ্চা প্যারালাইসিস টিক বা আঁটুলিতে আক্রান্ত। অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা এই আঁটুলিরা তামাকসহ বিভিন্ন গাছের মাথায় উঠে যেতে পারে। এভাবেই বাদুড়েরা এই আঁটুলিদের সংস্পর্শে আসে। যখন এভাবে আঁটুলি আক্রান্ত কোনো বাদুড়কে গাছ কিংবা ঝোপ-জঙ্গলে আবিষ্কার করা হয় ততক্ষণে এর শরীর অবশ হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে এদের তখন অ্যান্টি-প্যরালাইসিস ইনজেকশন দেওয়া হয়। তারপর অপেক্ষার পালা। বাদুড়টাকে যদি কোনো ধরনের জুস পান করানো যায় এবং আঁটুলির বিষ ধীরে ধীরে মৃদু হয়ে আসে—বোঝা যাবে এর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার কিছু কিছু বাদুড়ের অঙ্গহানি এমনকি মারাও যায়।
এমনিতে একটি-দুটো অসুস্থ বাদুড়কে কোথাও রেখে বড় করলে তার সঙ্গী পাওয়ার সুযোগ থাকে না। কিন্তু এই হাসপাতালে অনেক বাদুড় একসঙ্গে থাকায় এরা আনন্দে থাকে এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। হাসপাতালটিতে প্রতি বছর ১২০০-র মতো বাদুড়ের সেবা ও চিকিৎসা করা হয় কুইন্সল্যান্ড ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্ট থেকে নেওয়া পারমিটের মাধ্যমে। এগুলোর বেশিরভাগকেই সুস্থ অবস্থায় প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়।
এখানে মূল কাজটা করেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের পাশাপাশি বাইরের স্বেচ্ছাসেবীরাও কাজ করতে পারেন এখানে। স্বেচ্ছাসেবা দিতে আগ্রহীদের অবশ্যই অস্ট্রেলিয়ান ব্যাট লিসাভাইরাসের টিকা ও র্যাবিস ভ্যাকসিন দেওয়া থাকতে হয়। আপনার বয়স ২১-এর কম হলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এখানে কাজ করার সুযোগ কম। সাধারণত কারও চিকিৎসা, পশু চিকিৎসা কিংবা আইটি ও পরিবেশবিজ্ঞানে ডিগ্রি থাকলে তাঁদের বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। সাধারণত অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার থেকে আটজন সার্বক্ষণিক বাইরের স্বেচ্ছাসেবী প্রয়োজন হয়। কারণ এ সময় বাদুড়েরা আঁটুলি আক্রান্ত হওয়ার সময়। বছরের বাকি সময়টা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দিয়েই মোটামুটি কাজ চলে।
কাজেই অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ হলে কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাদুড়ের হাসপাতালটিতে একটি চক্কর দিয়ে আসতে পারেন। হাতে সময় থাকলে এবং বাদুড় পছন্দ করলে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও কয়েকটি দিন কাটাতে পারেন সেখানে।
সূত্র: টোলগা ব্যাট হসপিটাল ডট অরগ, বোরড পানডা, অস্ট্রেলিয়ান জিওগ্রাফিক ডট কম