কঙ্কন সরকার
কাতারের সর্বাধুনিক ফুটবল মাঠগুলোতে যখন মেসি, নেইমার, এমবাপ্পে, রোনালদোর মতো খেলোয়াড়েরা নৈপুণ্যের ঝড় তুলছেন, তখন খুব নীরবে আমাদের ফুটবল জাদুকরের জন্মদিন এসে চলে যাচ্ছে।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই মনে পড়েছে, আমাদেরও একজন ফুটবল জাদুকর ছিলেন। তাঁর নাম সৈয়দ আবদুস সামাদ। অবিভক্ত ভারতের বিহারের পুর্ণিয়ায় জন্মেছিলেন তিনি, সালটা ১৮৯৫ সালের ৬ ডিসেম্বর। অবশ্য কোথাও কোথাও পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের ভুরী গ্রামের নামও বলা হয় তাঁর জন্মস্থান হিসেবে!
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হলে সামাদ চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রেলওয়ে শহর পার্বতীপুরে। এরপর পুরো জীবন তিনি কাটিয়েছেন ছোট্ট এ শহরে।
ছোটবেলা থেকে ফুটবলের প্রতি এক দারুণ আকর্ষণ ছিল সামাদের। মনোযোগ দিতে না পারায় অষ্টম শ্রেণির পর পড়াশোনায় ইতি টানেন। এরপর ফুটবলেই পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন; মাঠের সঙ্গে গড়ে তোলেন সখ্য। তাঁর গতি ছিল চিতার সমতুল্য, ড্রিবলিং ছিল মনোমুগ্ধকর!
সামাদ ১৯১২ সালে যোগ দেন কলিকাতা মেইন টাউন ক্লাবে। ১৯১৬ সালে ইংলিশ ক্লাব সমারসেটের হয়ে মাঠে নেমে নৈপুণ্য দেখিয়ে মুগ্ধ করেন জাত্যাভিমানী ব্রিটিশদের। ১৯২১ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত তিনি খেলেছেন বিখ্যাত ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের হয়ে। ১৯২৭ সালে তাঁর দারুণ এক গোলে ইংল্যান্ডের ম্যাশউড ফরেস্ট দলের বিপক্ষে জয় পেয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল। ১৯৩৩ সালে মোহামেডানে যোগ দেন সামাদ এবং পরপর পাঁচবার আইএফএ শিল্ড ও লিগ জয় করেন।
১৯২৪ সালে সামাদ ভারতের জাতীয় ফুটবল দলে নির্বাচিত হন এবং ১৯২৬ সালে দলটির অধিনায়ক হন। তিনি ভারতের হয়ে সে সময়কার মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা), সিলোন বা শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন এবং ইংল্যান্ড সফর করেন।
এর পরের প্রায় পুরো খেলোয়াড়ি জীবনে সামাদ জন্ম দিয়েছেন অনেক ঘটনার। সেসব ঘটনা উড়তে উড়তে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। এর একটি হলো—ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে পরপর দুটি বল গোলবারে লেগে ফেরত এলে সামাদ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন—গোলবারের উচ্চতা কম আছে। পরে মেপে দেখা যায়, সামাদের কথা সত্য। এমন আরও অনেক ঘটনা আছে তাঁর ২৩ বছরের খেলোয়াড়ি জীবনে। এমনও শোনা যায় যে, সামাদকে হাঁটতে দেখে সে সময়কার বাংলার গভর্নর আর তাঁর মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে এসেছিলেন!
ফুটবলে অসাধারণ ক্রীড়া নৈপুণ্যের জন্য ‘জাদুকর’ আখ্যা পেলেও শেষ জীবনে দারিদ্র্যের কশাঘাতে প্রায় বিনা চিকিৎসায় ১৯৬৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মারা যান সৈয়দ আব্দুস সামাদ।
পার্বতীপুর শহরের ইসলামপুর কবরস্থানে সমাহিত আছেন তিনি। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে তাঁর স্মরণে স্মৃতিসৌধ। তাঁর নামে একটি স্মারক ডাকটিকিটও প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ সরকার। পার্বতীপুরে ‘সামাদ ইনস্টিটিউট’ নামে একটি মিলনায়তন আছে, সেটি এখন পরিত্যক্ত।