গ্রামের একটি রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। দুপাশে ঘর-বাড়ি। কিন্তু সেগুলোর দিকে তাকাতেই চমকে উঠবেন। কারণ, একটি বাড়িরও দরজা নেই। অবিশ্বাস্য শোনালেও এমন অভিজ্ঞতা আপনার হবে ভারতের মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর জেলার শনি শিংনাপুর গ্রামে গেলে। এখানকার বাড়ি-ঘর, দোকানপাট কোনো কিছুরই দরজা নেই। একটি গর্ত বা ফ্রেমের মতো আছে আসা-যাওয়ার জন্য, তবে এর বাইরে দরজার কোনো অস্তিত্ব নেই।
এভাবে দরজা ছাড়া থাকতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত গ্রামটির বাসিন্দারা কোনো ধরনের নিরাপত্তার অভাবও অনুভব করে না। তারা মনে করে, দেবতা শনি এই গ্রামের দেখভালের দায়িত্বে আছেন, তিনিই গ্রামটির বাসিন্দাদের নিরাপত্তা দেবেন। তবে এই দরজা খোলা রাখার পেছনে আছে ৩০০ বছরের পুরোনো এক কিংবদন্তি।
এবার বরং পুরোনো সেই কিংবদন্তিটা কী, সেটা জেনে নেওয়া যাক। প্রবল বৃষ্টি আর বন্যার পরে জলের তোড়ে ভেসে আসা কালো একটি বড় পাথর আবিষ্কার করে গ্রামবাসী পানাসনালা নদীর তীরে। ওই সময় গ্রামটির মাঝখান দিয়ে বয়ে যেত নদীটি। স্থানীয় বাসিন্দারা যখন লাঠি বা লোহার রডের মতো কিছু একটা দিয়ে দেড় মিটার ব্যাসের পাথরটা স্পর্শ করল, সেখান থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত বের হতে লাগল। ওই রাতেই গ্রামপ্রধানের স্বপ্নে দেখা দিলেন দেবতা শনি। বললেন, পাথর তাঁর প্রতিনিধিত্ব করছে। শনির পাথরটিকে গ্রামেই রাখার নির্দেশ দিলেন। তবে একে কোনো ছাউনির নিচে রাখা যাবে না। কারণ তাহলে কোনো বাধা ছাড়া গোটা গ্রামটি দেখা সম্ভব হবে তাঁর পক্ষে। তারপর দেবতা শনি গ্রামপ্রধানকে কথা দিলেন গ্রাম ও গ্রামবাসীর যেকোনো বিপদে তিনি তাদের রক্ষা করবেন।
আর সেই ঐতিহ্য গ্রামবাসী মেনে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। কখনো কখনো গ্রামবাসী ঘুরে বেড়ানো কুকুরদের দূরে রাখার জন্য দরজার জায়গায় কাঠের খোলা একটা প্যানেলের মতো রাখে, তবে সেই অর্থে দরজা বস্তুটির দেখা পাবেন না। অলংকার, টাকার মতো জিনিসও খোলা জায়গায় রেখে দেন এই বিশ্বাসে যে দেবতা তাদের যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। এমনকি গ্রামের মাঝখানের চত্বরের পাশের পাবলিক টয়লেটেও কেবল একটি পর্দা ঝোলানো থাকে, তবে কোনো কপাট থাকে না।
গ্রামবাসী এতটাই নির্ভার যে যখন গ্রাম ছেড়ে কোথাও বেড়াতে যায়, প্রতিবেশীদের বলে যাওয়ারও প্রয়োজন মনে করে না তাদের ঘর-বাড়ি একটু দেখেশুনে রাখতে। তাদের বিশ্বাস, চোর সঙ্গে সঙ্গে তার শাস্তি পেয়ে যাবে অন্ধ হয়ে গিয়ে, আর কেউ অন্য কোনো ধরনের অসততা দেখালে সাড়ে সাত বছর মন্দভাগ্যের চক্করে পড়ে থাকতে হবে। এমনকি গ্রামবাসীর মধ্যে এমনও প্রচলিত আছে, একজন গ্রামবাসী এভাবে দরজার জায়গায় কাঠের কপাট লাগানোর পরদিন গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েন।
শনি শিংনাপুর অফিশিয়ালি চুরিমুক্ত শত শত বছর ধরেই। সত্যি বলতে, গ্রামে বড় ধরনের চুরির ঘটনা ঘটেই না। তবে বিচ্ছিন্ন দু-চারটি ছোটখাটো ঘটনা ঘটে না যে তা নয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ২০১০ সালে এক পর্যটক জানান তাঁর গাড়ি থেকে ৩৫ হাজার রুপি পরিমাণ নগদ অর্থ ও মালামাল চুরি গেছে। ২০১১ সালে আবার ৭০ হাজার রুপির অলংকার চুরির একটি অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে এগুলো নিয়ে বেশি মাতামাতি হয়নি। কারণ গ্রামবাসী জোর গলায় দাবি করে, ঘটনাগুলো গ্রামের বাইরে ঘটেছে।
তবে সত্যি যাই হোক, সময় বদলাচ্ছে। কিছু কিছু গ্রামবাসী পুরোনো এই রীতিকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য দরজা ও তালা লাগানোর অনুমতি চাওয়া শুরু করেছেন।
এমনকি গ্রামের কেউ কেউ কাঠের স্লাইডিং দরজা ব্যবহার শুরু করেছেন। আশপাশের গ্রামগুলোতে ডাকাতির কয়েকটি ঘটনা ঘটায় কিছু গ্রামবাসী নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এটা করছে। বাড়ি তৈরির ধরনও বদলাচ্ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, বেশির ভাগ গ্রামবাসী এখনো চায় পুরোনো ঐতিহ্য অটুট থাকুক। আর তাই ইমারত নির্মাতারাও কিছু সৃষ্টিশীল সমাধানের দিকে এগোচ্ছেন। যেমন স্লাইডিং দরজার ব্যবহার, যেন বাইরে থেকে দেখে দরজা নেই বলে মনে হয়।
ভারত সফরে আশ্চর্য এই গ্রাম একবার দেখে আসতে চান? তাহলে সেখানে যাওয়ার পথটা বাতলে দিচ্ছি। আওরঙ্গবাদ-আহমেদাবাদ সড়ক ধরে গেলে সহজেই পৌঁছে যেতে পারবেন গ্রামটিতে। নিকটতম রেলস্টেশন রাহুরি শনি শিংনাপুর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে। আর আহমেদনগর রেলস্টেশনের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার। সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর আওরঙ্গবাদ, গ্রামটি থেকে মোটামুটি ৯০ কিলোমিটার দূরে।
সূত্র: বিবিসি, আউটলুক ইন্ডিয়া, টাইমস অব ইন্ডিয়া