কানাডার উত্তর মানিটোবার দুর্গম এলাকায় অবস্থিত ছোট্ট এক শহর চার্চিল। হাজারের কম জনসংখ্যার শীতল শহরটির এমনিতে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো তেমন কিছু নেই। তারপরও পর্যটকদের টানে শহরটি। কারণ, এখানে বিপুলসংখ্যক মেরু ভালুকের আনাগোনা। শুনে অবাক হবেন, চার্চিলে এমন একটি জিনিস আছে—যেটা পৃথিবীর আর কোথাও নেই, সেটি মেরু ভালুকের জেলখানা।
হাডসন উপসাগরের তীরে অবস্থিত শহরটির মানিটোবা প্রদেশের রাজধানী উইনিপেগ থেকে দূরত্ব প্রায় হাজার কিলোমিটার। কানাডার সবচেয়ে দুর্গম শহরগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় একে। এত উত্তরের খুব কম জায়গাতেই মানুষের বসতি আছে। তবে প্রচণ্ড শীতল আবহাওয়া আর বিচ্ছিন্নতা ছাড়াও এখানকার অধিবাসীদের বড় আরেকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। সেটা মেরু ভালুক বা পোলার বিয়ার। এমনকি দিনের আলোতেও শহরের বাসিন্দাদের এদের দেখা পেয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
৪ অক্টোবর, ২০২২। চার্চিলের একজন সংরক্ষণ কর্মকর্তা চ্যান্টাল ক্যাজার ম্যাকলিনের কাছে খবর এল একটি মেরু ভালুক শহরের প্রান্তে কারও ঘরের পাশের চালায় ঢুকে পড়েছে। কম বয়স্ক মাদি ভালুকটি খাবারের জন্য কয়েক দিন ধরে শহরের সীমানায় ঘোরাফেরা করছিল। কিন্তু এখন ম্যাকলিনসহ চার্চিলের পোলার বিয়ার পেট্রল টিম বা টহল দলের কয়েকজন সদস্য তাকে শেডের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।
‘দুর্ভাগ্যবশত এখন মানুষের বাড়ির লাগোয়া বিভিন্ন দালানে ঢুকে পড়ছে ভালুকটি।’ বলেন ম্যাকলিন। অর্থাৎ এটি যেকোনো সময় কারও ঘরে ঢুকে পড়তে পারে। ম্যাকলিনদের সামনে একটি উপায়ই খোলা আছে তা হলো, একে ওষুধ প্রয়োগ করে ঘুম পাড়িয়ে মেরু ভালুক রাখার জায়গা বা জেলখানায় আটকে রাখা।
শীতকালে মেরু ভালুকগুলো বরফে জমে যাওয়া উপসাগরে অবস্থান করে সিল শিকার করে। কিন্তু জুলাই মাসে বরফ গলে গেলে, তারা আশপাশের জমিতে চলে আসে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে খাবার পাওয়া মুশকিল। ‘সিলের চর্বি খেয়ে শীতকালে শরীরে যে চর্বি জমে এগুলোই এ সময়টায় এদের বাঁচিয়ে রাখে’ ব্যাখ্যা করেন র্যাচেল সুলিভান-লর্ড, যিনি একাধারে একজন মেরিন বায়োলজিস্ট এবং এই অঞ্চলে মেরু ভালুক পর্যটন ট্যুর পরিচালনাকারী ন্যাচারাল হ্যাবিট্যাট অ্যাডভঞ্চারসের অভিযাত্রী দলের নেতা। র্যাচেল আরও বলেন, ‘নভেম্বরের শেষের দিকে, তারা তীরে আসে এবং উপসাগরের পানি জমে বরফ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। এর আগের কয়েকটি মাস ধরে শিকারের তেমন একটা সুযোগ না পাওয়ায় ভালুকগুলো থাকে ক্ষুধার্ত। কাজেই খাবার পাওয়ার সব ধরনের সুযোগ কাজে লাগায়।’
এবার মূল কাহিনি অর্থাৎ মেরু ভালুকদের জেলখানার বিষয়ে ফিরে আসা যাক। পোলার বিয়ার জেল নামটি জনপ্রিয়তা পেলেও এটা আসলে সে অর্থে জেলখানা নয়। বরং একে একটি হোল্ডিং ফ্যাসিলিটি বা ভালুককে সাময়িকভাবে আটকে রাখার জায়গা বলতে পারেন। এতে আছে ২৮টি সেল বা খোপ। এমনিতে কামরাগুলো তৈরিতে কয়লা ও সিমেন্টের ব্লক ব্যবহার করা হলেও দরজা ও ছাদের নিচের অংশ ইস্পাতের। নিজেরা মারামারি করতে পারে বলে বেশির ভাগ সেল একটি করে ভালুক থাকার উপযোগী। তবে দুটি বড় কক্ষ আছে বাচ্চাসহ মা ভালুক থাকার জন্য।
গ্রীষ্মের সময় কিছুটা আরাম দেওয়ার জন্য পাঁচটি সেল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। কিছু ভালুকের ওষুধ প্রয়োগ করে ঘুম পড়িয়ে আনা হয়। অন্যরা জেগে থাকা অবস্থায় আসে। ফাঁদে সিল মাংসের টুকরো দিয়ে প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ভেতরে বন্দী করা হয়।
১৯৫০-র দশকে চার্চিল যখন সেনা ঘাঁটি ছিল, তখন এই স্থাপনাটি তৈরি করা হয়। ‘এই সুবিধাটি থাকার ফলে বিপজ্জনক ভালুকগুলোকে গুলি করার পরিবর্তে টহল দল তাদের কয়েকটা সপ্তাহ এখানে রাখে। যতক্ষণ না উপসাগরটি বরফের আবরণে ঢেকে যায়।’ বলেন পোলার বিয়ার ইন্টারন্যাশনাল নামর ভালুক সংরক্ষণে কাজ করা অলাভজনক একটি সংস্থার সংরক্ষণবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক জিওফ ইয়র্ক।
জেলখানার পরিবেশ এই প্রাণীদের শেখায় যে মানুষের কাছে যাওয়াটি বিরক্তিকর এক অভিজ্ঞতা, আর এটি না করাই উত্তম। এ কারণেই ভালুকগুলো তাদের কক্ষে একটু নড়াচড়া ছাড়া খুব বেশি কিছু করতে পারে না। তারা দেয়ালে আঘাত করতে পারে। একে অবশ্য একটি ভালো লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ম্যাকক্লিন বলেন, ‘একটি ভালুক শব্দ করার অর্থ সে সুস্থ আছে।’
আটকে থাকা ভালুকগুলোকে বরফ ও পানি দেওয়া হলেও খাবার দেওয়া হয় না। কারণ, মানুষ থেকে যে খাবার পাওয়া যেতে পারে—এ ধারণাটি যেন তাদের মধ্যে না আসে।
‘এ সময়টা এরা এমনিতেও উপবাসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল’ ম্যাকক্লিন ব্যাখ্যা করেন।
‘তা ছাড়া এরা প্রায় ঠিক একই ওজন হারাচ্ছে, যেটা তারা বাইরে থাকলে হারাত।’ বলেন ইয়র্ক।
‘শাস্তি’ ভালুকদের জন্য শেষ ব্যবস্থা। শুরুতে ফাঁকা গুলি ও আতশবাজি ফাটিয়ে এদের শহর থেকে দূরে রাখা হয়। এতে কাজ না হলে তখন বন্দী করা হয়। এটা একদিক থেকে ভালোই। কারণ, না হলে মানুষের সঙ্গে ঝামেলা করায় হয়তো এদের প্রাণ দিতে হতো।
বেশির ভাগ ভালুককে ৩০ দিন বা উপসাগর জমে যাওয়া পর্যন্ত জেলখানায় রাখা হয়। বরফ তৈরি হলেই এদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ছেড়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখতে শহরের বাসিন্দারা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন। ট্র্যাপ ডোর দিয়ে একটি একটি করে ভালুককে বের করে দেওয়া হয়। বরফের দিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য একটি ট্রাক প্রতিটি ভালুককে তাড়া করে।
২০২২ সালে উপসাগরটি হিমায়িত হওয়ার সময় মাত্র পাঁচটি বন্দী ভালুক ছিল মুক্তির অপেক্ষায়। ছেড়ে দেওয়ার পর মনের আনন্দে এদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় বরফের ওপর।
আগে যেসব মেরু ভালুক শহরে ঘুরে বেড়াত, এদের গুলি করে মারা হতো। কিন্তু এটি দুটি প্রজাতির মধ্যে দ্বন্দ্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। তাই ১৯৭০-এর দশকে, চার্চিল পোলার বিয়ার অ্যালার্ট প্রোগ্রাম চালু করা হয়। এখন শহরের বাসিন্দারা কোনো ভালুককে দেখলে হটলাইন নম্বরে ফোন দেন। তখন প্রোগ্রামের কর্মীরা বাজি বা রাবার বুলেট ছুড়ে ভালুকটিকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেন। যদি এটি কাজ না করে, ভালুকটিকে ঘুম পাড়ানি গুলি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে ভালুক রাখার জায়গা বা পৃথিবীর একমাত্র ‘ভালুকদের কারাগারে’ নিয়ে যাওয়া হয়।
যদি ভালুকটি একেবারে বাচ্চা বা বেশি বয়স্ক হয়, অর্থাৎ বুনো পরিবেশে ছেড়ে দেওয়ার উপযোগী না হয়, তবে উইনিপেগের অ্যাসিনিবোইন পার্ক চিড়িয়াখানায় স্থানান্তর করা হয়।
মজার ঘটনা ভালুকদের বিচরণ ও প্রতিবছর এ এলাকা দিয়ে উপসাগরের দিকে যাওয়াটা শহরটিকে পর্যটকদের পছন্দের এক গন্তব্যে পরিণত করেছে। এখানে তাঁদের থাকার জন্য ‘তুন্দ্রা লজ’ নামের মৌসুমি একটি হোটেলও আছে।