অ্যান্টার্কটিকার নাম শুনলেই প্রচণ্ড শীতল আবহাওয়া, বরফ আর পেঙ্গুইনের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু যখন জানবেন এখানে একটি ডাকঘরও আছে, তখন নিশ্চয় অবাক হবেন। একে বিবেচনা করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম ডাকঘর হিসেবে। দেখা মিলবে অ্যান্টার্কটিকার পোর্ট লকরয়ে।
এই ডাকঘরে যাঁরা দেখভাল করেন, তাঁরা কী করে এই বৈরী পরিস্থিতিতে থাকেন, সেটাও নিশ্চয় চিন্তায় ফেলে দিয়েছে আপনাকে। তাহলে শুনে রাখুন, ডাকঘরটিতে সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন যে চারজন, তাঁদের সবাই নারী। গত বছর ক্লেয়ার ব্যালেন্টাইন, লুসি ব্রাজোন, নাতালি করবেট ও মাইরি হিলটন নামের এই চার নারী দায়িত্ব পান এটি পরিচালনার। মজার ঘটনা, দুর্গম এই ডাকঘরে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রায় ৬ হাজার মানুষ আবেদন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে নির্বাচিত করা হয় চারজনকে।
তবে সারা বছর কিন্তু তাঁরা এই বরফরাজ্যে থাকেন না। গ্রীষ্মের সময়টা, মানে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস তাঁদের এখানে কাজ করতে হয়। অর্থাৎ, মাস দু-এক আগেই কাজের পালা চুকিয়েছেন তাঁরা। করোনার কারণে এর আগে কয়েক বছর বন্ধ ছিল এটি।
আচ্ছা, ডাকঘরের কর্মচারীদের কাজ কী? ডাকঘর যেহেতু, চিঠিপত্রের একটা ব্যাপার তো আছেই, সেই সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকার পেঙ্গুইনের সংখ্যাও গুনতে হয়। তাই একে পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস বা পেঙ্গুইন ডাকঘর বলেও চেনেন অনেকে।
পোর্ট লকরয় জায়গাটি কোথায় এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে দু-চার কথা হয়ে যাক। এটি পড়েছে অ্যান্টার্কটিকার গওডিয়া দ্বীপে। ঐতিহাসিক এই জায়গা বিশ শতকের গোড়ার দিকে তিমি শিকারি জাহাজের বহরগুলো ব্যবহার করত। অ্যান্টার্কটিকায় ব্রিটিশদের নিয়মিত আনাগোনার প্রথম এলাকা বলা চলে একে।
পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি গোপন সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ব্রিটিশরা। যুদ্ধ শেষে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এটি গবেষণা স্টেশন হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে।
এখন পোর্ট লকরয়ের সবচেয়ে বড় পরিচয় পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম ডাকঘরের উপস্থিতির জন্য। এখানে একটি জাদুঘরও আছে। গ্রীষ্মে প্রচুর পর্যটকেরও আনাগোনা থাকে। এ সময় এখানকার তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের সামান্য ওপরে থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে। যুক্তরাজ্যের মালিকানাধীন হলেও সেখান থেকে এর দূরত্ব ৯ হাজার মাইলের মতো।
পোর্ট লকরয়ের কর্মচারীদের বছরে পৃথিবীর আনুমানিক ১০০ দেশে ৮০ হাজার পোস্টকার্ড পাঠাতে হয়। পেঙ্গুইনসহ বরফরাজ্যের অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সংখ্যাও গুনতে হয় তাঁদের। এ কারণেই এর আরেক নাম পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস।
আগেই বলেছি, এখানকার জীবন মোটেই সহজ নয়। এমনকি গ্রীষ্মেও তুষারঝড় অতি স্বাভাবিক ঘটনা। যেমন ওই চার নারী দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার দুই মাস পেরোতে না পেরোতেই ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হয় যুক্তরাজ্যের দ্য রয়েল নেভিকে। ওই সময় এতটাই বরফ পড়ে যে দালান-কোঠাগুলো মোটামুটি বরফে ডুবে যায়।
এইচএমএস প্রটেক্টরের নাবিক ও নৌসদস্যদের দুই দিনের চেষ্টায় পোর্ট লকরয়ের দালানগুলো খুঁড়ে বের করা হয়। ব্রান্সফিল্ড হাটের ক্ষতিগ্রস্ত ছাদটিরও সংস্কার করা হয়। এর তলেই গিফট শপ, জাদুঘর ও পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গমের ডাকঘরের অবস্থান।
তবে এই বরফরাজ্যে জীবন সহজ না হলেও জায়গাটিতে কাজ করতে পেরে খুব খুশি এই চার নারী। ‘এটা অনেকটা একাকী মধুচন্দ্রিমার মতো’ বলেছিলেন গিফট শপের দায়িত্বে থাকা নাতালি করবেট, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম জায়গাগুলোর একটিতে পেঙ্গুইনভর্তি একটি দ্বীপে কাজ করতে কার আপত্তি থাকবে বলুন?’ কাজেই বুঝতে পারছেন, যতই দুর্গম জায়গা হোক, পরের দফায় লোক নেওয়ার সময়ও আগ্রহী প্রার্থীর অভাব হবে না।
সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার, বিবিসি, ভেইল ম্যাগাজিন