বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় জঙ্গল থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসে লাল কাঁকড়ারা। একপর্যায়ে দ্বীপের রাস্তাঘাট লাল হয়ে যায় কাঁকড়ায়। পথে নালা, পাথর যা-ই পড়ুক না কেন, সব ডিঙিয়ে এরা ছুটে চলে সৈকতের দিকে। এমন আশ্চর্য দৃশ্য আপনার দেখার সৌভাগ্য হতে পারে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিসমাস দ্বীপে গেলে।
ক্রিসমাস দ্বীপের মাঝখানের মাল ভূমির বড় অংশ জুড়ে রেইন ফরেস্ট। দ্বীপটিতে মোটামুটি উষ্ণমণ্ডলীয় জলবায়ু নজর কাড়ে। এখানে বর্ষা ও শুকনো দুই মৌসুমের প্রভাবই চোখে পড়ে। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলে এখানকার বর্ষা আর শুকনো মৌসুম মে থেকে নভেম্বর। দ্বীপটিকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলেছে এখানকার লাল কাঁকড়ার মাইগ্রেশন বা জঙ্গল থেকে ভারত মহাসাগরের দিকে যাত্রা।
বর্ষা মৌসুমের প্রথম বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হয় কাঁকড়াদের যাত্রা। এটা সাধারণত ঘটে অক্টোবর-নভেম্বরে। তবে কখনো কখনো এটা ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে গিয়ে ঠেকে।
কাঁকড়ারা প্রথম বৃষ্টি ঝরা পর্যন্ত অপেক্ষা করে চলা শুরুর জন্য। তাই কখনো কখনো তাড়া থাকে তাদের। যদি ডিম পাড়ার উপযুক্ত সময়ের ঠিক আগে বৃষ্টি হয়, তবে তাদের দ্রুত চলতে হয়। তবে বৃষ্টি আগেই শুরু হয়ে গেলে সময় নিয়ে ধীরে-সুস্থে যেতে পারে। ভারত মহাসাগরের তীরে পৌঁছানোর পথে তখন তারা খাওয়ার জন্য বিরতি দেয়। যদি বৃষ্টি শুরু হতে বেশি দেরি হয়, তবে কিছু কাঁকড়া নিজেদের গর্তের আস্তানায় থেকে যায়। পরের মাসে সাগরের দিকে যাত্রা করে তারা।
তারপর গর্তের কাছেই পুরুষ কাঁকড়ার সঙ্গে মিলিত হয় স্ত্রী কাঁকড়া। ঘরে ফেরার আগে পুরুষ কাঁকড়ারা সাগরে আরেকটা ডুব দেয়। এদিকে স্ত্রী কাঁকড়ারা রয়ে যায় সাগরতীরের ভেজা গর্তে। মিলনের তিন দিনের মধ্যে ডিম পাড়ে তারা। তবে ডিমগুলো আরেকটু পরিপক্ব হওয়ার জন্য আরও সপ্তাহ দুয়েক গর্তেই কাটায়। একেকটি স্ত্রী কাঁকড়া ১ লাখের মতো ডিম পাড়ে। শরীরের থলের মধ্যে থাকে ডিমগুলো।
পানির সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে ডিম থেকে লার্ভা বের হয়ে আসে। ঢেউয়ে গভীর সাগরে নিয়ে যাওয়ার আগে তীরের কাছের জল লার্ভায় ভরে থাকতে দেখা যায়। এই লার্ভারা পানিতে থাকে এক মাস। এ সময় লার্ভার নানা ধাপ পেরোয়। এগুলোর মধ্যে সাগরের তৈরি স্রোত আর বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর কবল থেকে অল্পসংখ্যকই টিকে থাকতে পারে। এরা যেসব প্রাণীর পেটে যায় তার মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের মাছ, মান্তা রে এমনকি হোয়েল শার্করা। এই হাঙরেরা এমনকি বছরের নির্দিষ্ট সময়ে দ্বীপটির আশপাশে হাজির হয় বড় একটা ভোজের আশায়।
বেশির ভাগ বছর খুব অল্প সংখ্যায় কাঁকড়ার বাচ্চাই টিকে যায়। তবে প্রতি দশকে একবার কি দুবার হয়তো দেখা যায় বিপুল সংখ্যায় বাচ্চা কাঁকড়া বেঁচে যায়। এটাই দ্বীপের বিপুল সংখ্যায় কাঁকড়ার বসতি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
দ্বীপের যেসব জায়গা থেকে সহজে এই যাত্রা কিংবা ডিম পাড়ার বিষয়টি উপভোগ করা যায়, তার মধ্যে আছে ড্রামসাইট, ফ্লাইং ফিস খাঁড়ি এবং ইথেল ও গ্রেটা সৈকত।
এই লাল কাঁকড়াদের রক্ষায় এই যাত্রার সময় কোনো কোনো রাস্তার কিছু অংশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে গাড়ি দাঁড় করিয়ে খুব সাবধানে এদের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যেতে পারবেন, উপভোগ করতে পারবেন আশ্চর্য এই যাত্রা।
দ্বীপের বাসিন্দারাও এই কাঁকড়াদের রক্ষায় খুব সচেতন। এ সময় গাড়ি চালান তাঁরা সতর্কতার সঙ্গে। রাস্তায় বসানো হয় ‘ক্র্যাব ক্রসিং’ সাইন। বিভিন্ন রাস্তায় তৈরি করা হয়েছে ক্র্যাব ব্রিজ বা কাঁকড়া সেতু। এসব সেতুতে দাঁড়িয়ে কাঁকড়াদের এই ভ্রমণ দেখতে পারবেন অনায়াসে। কাঁকড়াদের যাত্রার সময় বিভিন্ন নোটিশ বোর্ড আর স্থানীয় রেডিওতে প্রচার করা হয় এর সর্বশেষ খবর।
সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, পার্কস অস্ট্রেলিয়া, এটলাস অবসকিউরা