পাহাড়ের ওপর অবস্থিত পর্তুগালের ছোট্ট গ্রাম মোনসেনতোতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চমকে যাবেন। বিশাল সব পাথর ছড়িয়ে আছে গ্রামময়। আর কী আশ্চর্য! এখানকার ঘরবাড়িগুলোর কোনোটা পাথরের নিচে, কোনোটা ওপরে, কিছু কিছু আবার বিশাল দুই পাথরের মাঝখানে।
পর্তুগালের বেইরা বাইসা প্রদেশের এ গ্রামটি স্পেনের সীমান্ত থেকে কেবলই ২৫ কিলোমিটার দূরে। পর্তুগিজ শব্দ মোনসেনতোর অর্থ ‘হলি মাউন্টেন’ বা ‘পবিত্র পর্বত’। পর্বতের খাড়া এক ঢালে দাঁড়িয়ে আছে মোনসেনতো গ্রামটি। শত শত বছর ধরে এভাবেই বিশাল সব পাথরের সঙ্গে বাস করে আসছেন এখানকার অধিবাসীরা। বিরাটাকৃতির পাথর ও পাথুরে জমির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে এখানকার শানবাঁধানো রাস্তাগুলো। এখানে পাহাড়ের গায়ে বিছিয়ে থাকা পাথরগুলোর কোনো কোনোটির ওজন ২০০ টন।
অদ্ভুত এ অবস্থানের কারণে পাথরের মধ্যে এভাবে প্রথম গড়ে ওঠার পর গত ৫০০ বছরে খুব একটা বেশি কিছু বদলায়নি শহরটির। মোনসেনতোর শ আটেক বাসিন্দার কারও বাড়ির ছাদের কাজ করছে পাথর, কারও বেলায় আবার ঘরের দেয়াল হয়ে আছে পাথর।
এই পুরোনো চেহারা ধরে রাখার কারণে ১৯৩৮ সালের জাতীয় এক প্রতিযোগিতায় পর্তুগালের শহরগুলোর মধ্যে ‘সবচেয়ে বেশি পর্তুগিজ’ নির্বাচিত হয় ভোটে। মানুষের মুখে মুখে ওই তকমা ধরে রেখেছে এখনো। মজার ঘটনা, এর পর থেকে গ্রামটির চেহারা না বদলানোর কিছু নিয়ম-কানুনও মেনে চলা হয়। এখন গ্রামটি এক ধরনের লিভিং মিউজিয়াম বা জীবন্ত জাদুঘর বলা চলে একে। বর্তমানে পর্তুগালের সরকারিভাবে ঐতিহাসিক ভিলেজ বা গ্রামের মর্যাদা পাওয়া ১২টি জায়গার একটি এটি।
গ্রামের কিছু অংশে সরু রাস্তাগুলো গাড়ি চলাচলের জন্য খুব খাড়া, সেখানে শামুকের গতিতে হেঁটে চলেন এখানবার বাসিন্দা বা পর্যটকেরা। লালরঙা ছাদের বাড়িগুলোর কোনো কোনোটি বিশাল দুই পাথরের মাঝখানে নাকমুখ গুঁজে আছে। কোনো কোনো এক টালির ছাদের গোটাটাই আসলে ঢালু কোনো বিশাল পাথর।
শহরটি সম্পর্কে এখানকার অধিবাসীরা একটি মজার কথা বলে, তা হলো, ‘মোনাসানতোতে তুমি কখনো বলতে পারবে না পাথর থেকে বাড়ির জন্ম, নাকি বাড়ি থেকে পাথরের।’
গত শতকে মোনসেনতোর অধিবাসীরা একটু কম পাথরময় ছোট পাহাড়গুলোর দিকে সরে পড়তে শুরু করেন। যেখানে গাড়ি বা বাসে পৌঁছানো যায়। এখন পর্বতচূড়ার মূল শহরে মাত্র ১০০ জন অধিবাসীর বাস।
মোটামুটি দুই যুগ আগে পর্যন্ত মোনসেনতোর খাড়া ঢালের ওপরে বাস করা গ্রামবাসীরা ছিলেন মূলত কৃষক, তাঁরা যাতায়াতে নির্ভর করতেন গাধার ওপর। এখন অনেকেই কাছের ইদানহা-এ-নোভা শহরে কাজ করেন। কারও কারও পাথরের বাড়িতে আছে ইন্টারনেট সংযোগ। কেউ কেউ আবার বাড়তি আয়ের জন্য ছোট ছোট স্যুভেনির দোকান খুলেছেন।
শহরের ওপরের অংশ, যেটা একে অনন্য করেছে, সেটি ক্রমে মরে যেতে পারে বলে আশঙ্কা কোনো কোনো গ্রামবাসীর। তবে যতদিন পর্যন্ত পর্যটকেরা খাড়া ঢাল বেয়ে উঠে বারবিকিউ আর গানের সঙ্গে রাত উদ্যাপন করবেন, রহস্যময় মারাফোনা পুতুল দেখে বিস্মিত হবেন, বিশাল গ্রানাইটের পাথরের রেস্তোঁরার ভেতরে বসে খাবেন ততদিন পুরোনো মোনসেনতো টিকে থাকবে সন্দেহ নেই।
সূত্র: বিবিসি, এটলাস অবসকিউরা