একসময় সে ছিল এক শিশুর খেলার পুতুল। তখন থেকেই তাকে ঘিরে জন্ম নানা ভুতুড়ে ঘটনার। এখন এক জাদুঘরে বন্দী অবস্থায়ও তাকে বিবেচনা করেন অনেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভুতুড়ে পুতুল হিসেবে। গল্পটা রবার্ট দ্য ডলের।
কাঠামোটির পরনে সেইলর স্যুট, ছোটরা যেগুলো পরে। ছোট্ট মুখটায় অবশ্য একটা বালকের সঙ্গে মিল আছে কমই। সেখানে আঁচড়ের মতো কিছু দাগ বা খাঁজ আছে। চোখ পুঁতির মতো, কালো। মুখে লেগে আছে অশুভ একটি হাসি। কোলে একটা খেলনা কুকুর। এই তো গেল চেহারা। মানুষ এর সম্পর্কে অনেক কিছুই বিশ্বাস করে, তবে সেগুলোর কোনোটাই স্বাভাবিক কিছু নয়। চলুন পাঠক, তাহলে প্রবেশ করা যাক রবার্টের গা ছমছম করা জগতে।
রবার্ট দ্য ডল নামে পরিচিত পুতুল রবার্টের বর্তমান বয়স ১১৯, বাসস্থান ফ্লোরিডার কি ওয়েস্টের ইস্ট মারটেল্লো জাদুঘরে। নতুন একটি বাক্সের মধ্যে তাকে রাখা হয়েছে। জাদুঘরের কিউরেটর করি কনভেরটিটেটা জানান, যিনি এটি দিয়েছেন তিনি রবার্টের ভক্ত। তবে জলীয় বাষ্প নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা এবং ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি শুষে নেওয়া কাচসহ নতুন এ আস্তানা রবার্টের ওপর তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করেছে বলে মনে হয় না। কারণ, জাদুঘরে এখনো রবার্টের নানা অশুভ কীর্তিকলাপের অভিযোগ পাওয়া যায়।
১৯৯৪ সালে জাদুঘরে আসার আগে রবার্টের মালিক ছিলেন রবার্ট ইউজিন অট্টো নামের এক খামখেয়ালি শিল্পী ও কি ওয়েস্টের এক অভিজাত পরিবারের সদস্য। অট্টোদের বাড়িটি পরিচিত ‘আর্টিস্ট হাউস’ নামে। কেউ কেউ বলেন অট্টোর দাদা বালক বয়সের অট্টোকে পুতুলটি উপহার দেন। তবে বেশির ভাগ সূত্রের দাবি, অট্টোদের গৃহপরিচারিকা তাঁকে পুতুলটি দেন।
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও পুতুলটি হাতছাড়া করেননি অট্টো। বলা চলে তাঁদের এ সম্পর্কটা মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। সঙ্গে করে সব জায়গায় নিয়ে যেতেন পুতুলটাকে। ওটার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতেন যেন পুতুল নয়, এর জীবন আছে।
মজার ঘটনা হলো, রবার্টের গায়ে চাপানো কোটটা প্রস্তুতকারক কোম্পানির দেওয়া নয়, বরং যতদূর জানা যায় অট্টো নিজে ছোটবেলায় এটা পরতেন। এদিকে পুতুলটিকে আনার পর একটার পর একটা অশুভ ঘটনা ঘটতে লাগল। শিশু অট্টো এর জন্য দায়ী করে রবার্টকেই। বাড়ির বড় সদস্যরা একে বালকের গালগপ্প বলে উড়িয়ে দেন গোড়ার দিকে। তবে সময় যত গড়াতে লাগল বাড়ি ও পুতুলটিকে ঘিরে নানা ধরনের অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটতে দেখলেন তাঁরা।
অস্বাভাবিক ঘটনার শুরু যখন, অট্টোর তখন দশ বছর বয়স। এক রাতে ঘুম থেকে জেগে দেখেন বিছানার কিনারে বসে রবার্ট তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। অট্টোর চিৎকারে তাঁর মায়ের ঘুম ভেঙে গেল, অট্টোর কামরার আসবাবপত্র উল্টে পড়ার শব্দও কানে এল তাঁর। দৌড়ে এসে আবিষ্কার করলেন ছোট্ট ছেলেটা আতঙ্কে কুঁকড়ে শুয়ে আছে বিছানায়। পাশে মেঝেতে বসে আছে পুতুলটি। কিন্তু একটা পুতুল কীভাবে এমনটা করতে পারে?
তবে বিষয়টা পরিবারের সদস্যরা ভুলে যেতে চাইলেও এতেই থেমে থাকল না অস্বাভাবিক কাণ্ডকীর্তি। অট্টোর মা-বাবা মাঝে মাঝেই ওপর তলা থেকে পুতুলটির সঙ্গে কথা বলতে শুনতেন ছেলেকে। অন্য রকম কণ্ঠে জবাবও শুনতে পেতেন। এমনকি পুতুলটির মুখের অভিব্যক্তি বদলে যেতে দেখেন তাঁরা মাঝে মাঝেই।
মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আর্টিস্ট হাউসে স্ত্রী অ্যানের সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন অট্টো। অ্যান গোড়া থেকেই রবার্টকে নিয়ে একটু অস্বস্তিতে ভুগতে লাগলেন। চাইলেন একে চিলেকোঠায় বন্দী করে রাখতে। অতএব সেখানে ঠাঁই হলো তার। তবে কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল রবার্ট তার এ অবস্থানে মোটেই খুশি হয়নি। বাড়িটির পাশ দিয়ে স্কুলে যাওয়া ছেলে-মেয়েরা জানাল, পুতুলটি হঠাৎ দুই তলার শোবার কামরার জানালার সামনে হাজির হয়, পরমুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। যেন সে চলাফেরা করতে পারে। বাড়িটিকে এড়াতে অন্য পথে স্কুলে যেতে শুরু করল তারা।
১৯৭৪ সালে অট্টো মারা গেলে আর্টিস্ট হাউস কিনে নেন মার্টলে রিউটার। রবার্ট রইল তাঁর জিম্মাতেই। মার্টলেদের দশ বছরের মেয়ে শুরুতে পুতুলটিকে পেয়ে খুশিই ছিল। তবে একপর্যায়ে সে দাবি করল পুতুলটা হাঁটা-চলা করতে পারে, আর তাকে আঘাত করতে চায়। কখনো কখনো রাতে আতঙ্কে চিৎকার করে জেগে যেত সে। মা-বাবা এসে কী হয়েছে জানতে চাইলে বলত রবার্ট তার কামরায় চলে এসেছিল।
বাড়িটিতে বেড়াতে আসা লোকেরা দাবি করতে থাকলেন, চিলেকোঠায় মৃদু পদশব্দ আর ফিক ফিক করে হাসির শব্দ শোনেন তাঁরা। কেউ কেউ আবার জানালেন, রবার্টের সামনে তার আগের মালিক অট্টো সম্পর্কে কেউ কটু কথা বললে পুতুলটির চেহারায় রাগের ছাপ দেখা যায়। ২০ বছর রবার্টকে নিজের কাছে রাখার পর ফ্লোরিডার কি ওয়েস্টের ইস্ট মারটেল্লো জাদুঘরে দিয়ে দেন।
অনেকেই দাবি করেন, রবার্টের অশুভ আচরণের মূলে আছে অট্টোর বাড়ির সেই গৃহপরিচারিকা, যিনি অট্টোকে পুতুলটি উপহার দিয়েছিলেন। বলা হয়, অট্টোর মা-বাবা ওই নারীর সঙ্গে ভালো আচরণ করতেন না। এ জন্য তাঁদের শিক্ষা দিতে ভুডু আর ব্ল্যাক ম্যাজিকের সাহায্য নিয়ে পুতুলটির ওপর অশুভ প্রভাব তৈরি করেছিলেন। এতে অনেক প্রশ্নের জবাব মিললেও আরেকটি রহস্য রয়ে যায়, অট্টোর মা-বাবা, ওই গৃহপরিচারিকা এমনকি অট্টো মারা যাওয়ার পরও রবার্টের অশুভ প্রভাব রয়ে গেল কেন?
এমনকি রবার্টের নামে চিঠিও আসতে লাগল জাদুঘরের ঠিকানায়। তবে সাধারণ ভক্তদের কোনো চিঠি নয় সেগুলো, বেশির ভাগ ক্ষমা চেয়ে লেখা চিঠি। তাদের দাবি, জাদুঘরে এসে রবার্টের সঙ্গে অসম্মানজনক আচরণ করেছেন। তার পর থেকেই একটার পর একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটছে তাঁদের জীবনে। কাজেই মাফ চেয়ে এর থেকে মুক্তি চান। এমনকি তার জন্য ক্যান্ডি আর চকোলেটও পাঠাতে লাগলেন ভক্তরা। কখনো রবার্টকে কাচের ঘেরাটোপ থেকে ফ্লোরিডার মুক্ত আবহাওয়ায় বের কর আনেন তার কেয়রটেকার কনভারটিটো।
কনভারটিটোকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি কি মনে করেন রবার্ট ভুতুড়ে?’
‘আমি জানি না। সত্যি জানি না,’ উত্তর দিলেন তিনি, ‘রবার্টের সঙ্গে আমার কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা হয়নি। আমার কখনো অস্বস্তি লাগেনি। আমি আমার কাজ করে যাই। তার মধ্যে কিছু থাকুক না থাকুক, আমার কাজে সে কখনো বাধা দেয়নি।’
তবে তাকে দেখতে জাদুঘরে আসা মানুষকে এখনো আতঙ্কিত করে চলেছে রবার্ট। জাদুঘরে যাঁরা রবার্টের ছবি তোলেন, তাঁদের অনেকে দাবি করেন ওই সময়ই ক্যামেরা উল্টাপাল্টা আচরণ শুরু করে। জাদুঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলে আবার সব ঠিকঠাক। তার মানে রবার্টের অশুভ বা ভুতুড়ে তকমা দূর হচ্ছে না সহসাই।
সূত্র: এটলাস অবসকিউরা, ঘোস্টস অ্যান্ড গ্রেইভস্টোনস ডট কম