পশ্চিম আফ্রিকার সুন্দর দেশ মৌরিতানিয়া। মরুভূমির তরুণী মেহেদি শিল্পী একাগ্রচিত্তে আলপনা আঁকছেন তাঁর আজকের খদ্দের ইসেলেখে জেইলানির হাতে। জেইলানি খুব সতর্ক, কোনোভাবেই যেন ভেজা মেহেদিতে দাগ না পড়ে! ঠিক যেমনটি ছিলেন বিয়ের আগের দিন।
এবার কিন্তু তাঁর বিয়ে হচ্ছে না। হচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ! এ উপলক্ষে পরদিন হবে উৎসব। জেইলানির মা এই আনন্দে নিমন্ত্রণ করেছেন শহরবাসীকে। উল্লসিত কণ্ঠে বলছেন, তাঁর মেয়ে এবং মেয়ের প্রাক্তন দুজনেই ভালোভাবে বেঁচে আছে।
মায়ের কথা শুনে হাসলেন জেইলানি। তিনি তখন সামাজিক প্ল্যাটফর্ম স্ন্যাপচ্যাটে মেহেদির ছবি পোস্ট করতে ব্যস্ত। মেহেদির ছবি পোস্ট করা বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষণার আধুনিক সংস্করণ হয়ে উঠেছে। যদিও মৌরিতানিয়ায় এটি বহু পুরোনো সংস্কৃতি। বিচ্ছেদের উৎসবে আগে ছিল নাচ, গান আর ভোজ। এখন সেলফি প্রজন্মে এসে যুক্ত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। আলপনা আঁকা কেক। মেয়েরা এখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় গর্ব ভরে আনন্দের সঙ্গে বিচ্ছেদের ঘোষণা দেয়।
অনেক দেশের সংস্কৃতিতে বিবাহবিচ্ছেদকে লজ্জাজনক হিসেবে দেখা হয়। তবে মৌরিতানিয়ায় এটি কেবল স্বাভাবিকই নয়, নারীদের কাছে আনন্দের উপলক্ষ! কারণ, শিগগিরই তাঁর আবার বিয়ে হবে। বহু শতাব্দী ধরেই সেখানে নারীরা আরেক নারীর বিবাহ বিচ্ছেদে উৎসব করে। খাওয়া–দাওয়া, নাচ ও গান এই উৎসবের অনুষঙ্গ। বর্তমানে যোগ হয়েছে কেক এবং সামাজিক প্ল্যাটফর্মে ছবি পোস্ট করা। ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং সংগীতের সঙ্গে সেলফিও এখন অনেক গুরুত্ব বহন করে।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, দেশটিতে বিবাহবিচ্ছেদের হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। তবে মৌরিতানিয়ায় এ প্রসঙ্গে খুব বেশি নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। এর আংশিক কারণ হচ্ছে, এখানে বিবাহবিচ্ছেদ প্রায়শই মৌখিক হয়, নথিভুক্ত নয়।
দেশটিতে বিবাহবিচ্ছেদ এতটা সাধারণ কেন—সে প্রসঙ্গে দেশটির সমাজবিজ্ঞানী নেজওয়া এল কেত্তাব বলেন, মৌরিতানীয় সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মৌর সম্প্রদায় তাঁদের বাবার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে শক্তিশালী মাতৃতান্ত্রিক প্রবণতা পেয়েছে। দেশটির যাযাবর সম্প্রদায় নারীদের মর্যাদার কথা ছড়িয়ে দিয়েছে বহুদিকে। অন্যান্য মুসলিম দেশের তুলনায় মৌরিতানিয়ার নারীরা বেশ স্বাধীন।
তিনি আরও বলেন, দেশটিতে বিয়েকে পেশা হিসেবেও নেওয়া যায়।
এল কেতাব আরও বলেন, মৌরিতানিয়ায় একজন অল্পবয়সী তালাকপ্রাপ্ত নারী সমাজের কোনো সমস্যা নন। সেখানে তালাকপ্রাপ্ত নারীদের অভিজ্ঞ এবং কাম্য হিসেবে দেখা হয়। বিবাহবিচ্ছেদ নারীদের মূল্য বাড়িয়ে দেয়।
অনেক নারী বিবাহবিচ্ছেদকে স্বাধীনতার উপলক্ষ হিসেবে পান। বিশেষ করে প্রথম বিয়ের আগে বা বিয়ের সময় কখনো স্বপ্নেও বিচ্ছেদের কথা ভাবেননি এমন নারীর ক্ষেত্রে এমনটি বেশি ঘটে।
বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারে মৌরিতানিয়ার মানুষদের এই যে খোলামেলা চর্চা, এটি সচেতন প্রগতিশীল চর্চার বিষয় নয়, বরং এটি তাঁদের শত শত বছরের ঐতিহ্য। অভিভাবকেরা এখনো নিজেরাই পাত্র পছন্দ করেন এবং কন্যাদের বিয়ে দেন। এখানে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সে। এত কম বয়সে তাদের সঙ্গী পছন্দ করার সুযোগ থাকে না।
অনেক নারী আছেন যারা কখনোই বিবাহবিচ্ছেদের কথা ভাবেন না। এরপরও বিচ্ছেদ যদি ঘটেই যায়, তাহলে নারীদের সমাজে সমস্যায় পড়তে হয় না। কারণে এখানে এমন নারীদের কেউ নিন্দা করে না, বরং সমর্থন জানায়। সমাজই পরিস্থিতিকে সহজ করে তোলে।
কারও বিচ্ছেদ হওয়ার পর আয়োজিত উৎসবে অনেক নারী জড়ো হন। তাঁরা সমবেত কণ্ঠে গান করেন। তাঁরা প্রেমের গান গাইতে থাকেন। এরপর নবী মুহাম্মদের (সা.)–এর প্রতি প্রেম ও প্রশস্তি গাওয়া হয়। ঢোলের তালে তালি বাজানো হয়। কখনো কখনো অবশ্য মরুর বিষাদ সংগীতও গাওয়া হয়। আয়োজন থাকে প্রচুর খাবারের: উটের মাংস, খেজুরের নানা পদ, রুটি।
মৌরিতানিয়া হলো যাযাবর, উট আর আকাশ ভরা তারা ও উজ্জ্বল চাঁদের দেশ। কখনো কখনো ১০ লাখ কবির দেশও বলায় একে। হয়তো এ কারণেই এখানে বিবাহবিচ্ছেদও কাব্যিক!
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত ও সংক্ষেপিত