আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ)
জামেলা খাতুনের বয়স ৮০ পেরিয়ে গেছে। অনেক আগেই কর্মশক্তি হারিয়েছেন তিনি। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। কোটরাগত দুচোখ তাঁর সর্বস্ব হারানোর বিশদ উপাখ্যান। স্বামী সমেজ মিয়াকে হারিয়েছেন এক যুগ আগে। যমুনার ভাঙনে হারিয়েছেন ঘরবাড়ি। মানসিক ভারসাম্যহীন একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। স্বামী মারা যাওয়ার পর জামেলা প্রতিবেশীর বাড়িতে কাজ করে কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বছর পাঁচেক আগে একমাত্র ছেলে হঠাৎ মারা গেলে একেবারে একা হয়ে পড়েন জামেলা।
যমুনা নদীবেষ্টিত মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের বাশাইল গ্রাম। নদীর পারে অন্যের জায়গায় একটি জরাজীর্ণ ছাপরা ঘরে বৃদ্ধ জামেলা খাতুনের একার সংসার। প্রতিবেশীদের দয়ায় দিন কাটে তাঁর। জামেলা খাতুনের দুই চোখের জলও জমে গেছে বহু আগে। চরের জীবনে অন্য অনেকের মতো তাঁরও জীবন বয়ে চলে।
বিষয়টি স্থানীয় সাংবাদিক আমিনুল ইসলামের নজরে এলে তিনি তা ফেসবুকে প্রচার করেন। সেটি নজরে আসে জেলা প্রশাসক মানোয়ার হোসেন মোল্লার। তিনি তাৎক্ষণিক দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। যমুনা নদী পেরিয়ে দীর্ঘ বিস্তীর্ণ বালুময় পথ পাড়ি দিয়ে ইউএনও ছুটে যান জামেলা খাতুনের কাছে।
জরাজীর্ণ ছাপরা ঘরের ভাঙা দরজার পুরোনো ছেঁড়া কাপড়ের ফাঁক গলিয়ে উঠানে লোকজন দেখে বৃদ্ধ জামেলা হতভম্ব হয়ে পড়েন। ধাতস্থ হতে বেশ সময় লাগে তাঁর। উঠানের আগন্তুকেরা ইউএনও, থানার ওসি, সাংবাদিকসহ স্থানীয় বিশিষ্টজন। এসেছেন তাঁকে সহায়তার জন্য। সব শুনে খুশিতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন তিনি। একবার জড়িয়ে ধরেন ইউএনওকে, আবার জড়িয়ে ধরেন ওসিকে। তাঁদের মাঝেই যেন খুঁজে ফেরেন নিজের হারানো সন্তানকে। এমন দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবার চোখ ভিজে ওঠে।
জামেলা খাতুনকে দেওয়া হয় পাঁচটি কম্বল, এক বস্তা চাল, প্রয়োজনীয় ডাল, তেল, মুরগি এবং কিছু আসবাব। নিজস্ব তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তাও দেন ইউএনও আহসানুল আলম। এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জামেলার জন্য একটি বাড়ি, সেই সঙ্গে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন তিনি।
জীবনের শেষ সময়ে এই ভালোবাসাটুকু পেয়ে মুখে হাসি ফুটেছে জামেলা খাতুনের। আহসানুল আলম বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের নির্দেশে আমরা তাঁর খাবার এবং শীতবস্ত্র নিশ্চিত করেছি এবং খুব শিগগির তাঁকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হবে। সে জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি।’
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘একজন সর্বস্ব হারানো বৃদ্ধ মায়ের পাশে দাঁড়াতে পেরে আমি গর্বিত। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন তাঁর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন দৌলতপুর থানা অফিসার ইনচার্জ জে ও এম তৌফিক আজম, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান সজীব, উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. শাহ আলমসহ স্থানীয় লোকজন।