হোম > বিশ্লেষণ

চীনের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে আফগানিস্তান

জাহাঙ্গীর আলম

কাবুল দখল করে ফেলেছে তালেবান। তবে আপাতত স্বস্তির কথা হলো তারা কোনো ধরনের রক্তপাত করবে না ঘোষণা দিয়েছে। আশরাফ গনি সরকারকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে তারা। এ নিয়ে আলোচনা করতে কাতারের দোহায় গনি সরকারের একটি প্রতিনিধি দল যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওদিকে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি পদত্যাগ করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ ২০ বছর পর কাবুলে আবার তালেবান শাসন কায়েম হওয়ার এখন সময়ের অপেক্ষা।

যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার শুরুর পর কয়েক দিনের মধ্যে তালেবানের এই উত্থানের পেছনে শক্তি হিসেবে চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তানের নাম ঘুরে ফিরে আসছে। দেশটিতে চীনের বিপুল বিনিয়োগ। পেছনে থেকে তালেবানকে সমর্থন দেওয়ার অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক। তবে তালেবান ক্ষমতায় এলে মধ্য এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়বে সেটি নিয়ে চীনের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এছাড়া সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে চীন সরকার তাদের উদ্বেগের কথা বহুবার বলেছে। তালেবান যদিও বরাবর তাদের আশ্বস্ত করে এসেছে। এ ছাড়া আঞ্চলিক অস্থিরতার কবলে ঝুঁকিতে পড়তে পারে আফগানের মাটিতে বিপুল বিনিয়োগ ও মধ্য এশিয়ায় অবস্থানরত ১০ লক্ষাধিক চীনা নাগরিক। 

সোজা কথায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার আফগানিস্তানকে চীনের কাছে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

বেইজিংয়ের ইউয়ান ওয়াং মিলিটারি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের গবেষক ঝাউ চেনমিং বলেন, চীন আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিল, মধ্য এশিয়ার চরমপন্থী এবং সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো এই সেনা প্রত্যাহারের সুযোগে এই অঞ্চলে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। এতে চীনের বিনিয়োগ হয়ে উঠতে পারে তাদের লক্ষ্যবস্তু। 

মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশ–কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তানে প্রায় ১০ লাখ চীনা নাগরিক বাস করে। তাদের অধিকাংশই ছোটখাট ব্যবসা–বাণিজ্যর সঙ্গে জড়িত। ‘চীনের প্রধান উদ্বেগ হলো–ইটিআইএম–এর উত্থান ও সম্প্রসারণ। জিনজিয়াং এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য বেইজিং বারবার এই সংগঠনটিকে দায়ী করেছে।

এ ছাড়া বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে এই অঞ্চলে চীনা ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে সি চিন পিং সরকারের। 

এই পরিস্থিতিতে জরুরি বিকল্প হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করাটাই চীনের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। দেশটি একদিকে প্রতিবেশী, সেই সঙ্গে চীনের নেতৃত্বাধীন সাংহাই কো–অপারেশন অরগানাইজেশনের সদস্য।

রাশিয়া চীনের আনুষ্ঠানিক মিত্র না হলেও দুই দেশের সামরিক বাহিনী গত কয়েক বছরে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে জাপাড/ইন্টারঅ্যাকশন সামরিক মহড়া দিয়েছে তারা। যৌথ মহড়াটি নিংজিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের গোবি মরুভূমিতে পরিচালিত হয়। এতে ১০ হাজারের বেশি সেনা অংশ নেয়। 

চায়না একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের চীন–রাশিয়া বিশেষজ্ঞ সু চ্যাং বলেন, তিন দশকের সংঘাতের পরও আফগানিস্তান একটি কঠিন নিরাপত্তা ভবিষ্যতের সম্মুখীন হয়েছে। এখানে চীন ও রাশিয়ার যৌথভাবে কাজ করার সাধারণ শর্ত তৈরি হবে এখানে। আফগানিস্তানের ক্ষমতার হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে মাদক চোরাচালান, বিচ্ছিন্ন আকস্মিক হামলা এবং চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর তৎপরতা প্রতিরোধ আরও কঠিন হয়ে উঠবে। এই পরিস্থিতি চীন ও রাশিয়াকে একসঙ্গে নিরাপত্তা কাজে সামিল হওয়ার অপরিহার্যতাকে সামনে আনছে। রাশিয়াকে তার ঘরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যদিকে চীনের কাজ হবে ইটিআইএমকে জিনজিয়াংয়ে প্রবেশে বাধা দেওয়া। 

এদিকে আফগানিস্তান যখন গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ দখলের কথা বলছিল তখনই (গত মাসে) পাকিস্তানে একটি বাসে হামলায় নয় চীনা শ্রমিক নিহত হন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, এই মারাত্মক বিস্ফোরণটি ছিল ভারত ও আফগান গোয়েন্দা সংস্থার সমর্থিত ইসলামপন্থী জঙ্গিদের আত্মঘাতী বোমা হামলা। যদিও ভারত হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। 

এই পরিস্থিতির মধ্যে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই গত মাসে উত্তর চীনের শহর তিয়ানজিনে আফগান তালেবানের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। চীনের উত্তরাঞ্চলের তিয়ানজিন শহরে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তিনি সীমান্ত ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর জোর দেন এবং তালেবানকে ইটিআইএমের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানান। ওয়াং বলেন, ইটিআইএম–এর বিরুদ্ধে লড়াই করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাধারণ দায়িত্ব। 

বেইজিংয়ে চায়না ফাউন্ডেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো ইগল ইয়িন বলেন, রাশিয়া এবং আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে চীনকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। রাশিয়া ইটিআইএমকে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু তারা তালেবানের সঙ্গে প্রকাশ্যে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। ২০১৮ সালে তালেবানের একটি প্রতিনিধি দল রাশিয়া সফর করেছিল।

ইয়িন বলেন, বেইজিং এবং মস্কো এখন সমন্বয় ও সহযোগিতায় ঐকমত্যে পৌঁছেছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে চীন অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশি মনোযোগ দিতে পারে। আর রাশিয়ার অধিকতর নজর থাকবে আঞ্চলিক নিরাপত্তায়। 

আরও পড়ুন:

রাশিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের চুক্তি সারা, ট্রাম্পও কি জান্তার সঙ্গে হাত মেলাবেন

টেসলা ও স্টারলিংক ভারতে কতটা সুবিধা করতে পারবে

ট্রাম্প, বিটকয়েন এবং মার্কিন ডলারের ভবিষ্যৎ

নরেন্দ্র মোদির ‘সবার আগে প্রতিবেশী’ নীতি কেন ব্যর্থ হলো

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কোন পক্ষকে কতটা ছাড় দিতে হবে

নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ—পরিণাম কী হবে

যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা কী আসন্ন

চ্যাটবট থেকে বুদ্ধিমান খেলনা: এআই বাজারে অভাবনীয় আধিপত্যের পথে চীন

ঐতিহ্য ভুলে মার্কিন স্বার্থের কাছে নতি স্বীকার করছে ভারত

সৌদি আরব কেন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার আয়োজন করেছে