একদা স্থিতিশীল থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক পরিস্থিতি গত কয়েক বছর ধরেই কম-বেশি অস্থির। দেশটির নেতৃত্ব নিয়ে রাজনীতিবিদ এবং সাবেক-বর্তমান সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে চলে মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা। গণতন্ত্রের এমন নিয়ত বদলে যাওয়া রূপে জনগণও সন্তুষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতিতে গত মাসে ভেঙে দেওয়া হয় পার্লামেন্ট। আগামী ১৪ মে দেশটিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচন।
নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতায় ফেরার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সিনাওয়াত্রা পরিবার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার মেয়ে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা জোর প্রচার চালাচ্ছেন। গর্ভবর্তী অবস্থায় নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়ে বেশ আলোড়ন তোলেন তিনি। নির্বাচনী প্রচারণা চলার মধ্যেই গত ১ মে সন্তানের জন্ম দেন। ৩৬ বছর বয়সী এই নারী থাইল্যান্ডের ৫ কোটি ২০ লাখ ভোটারকে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। নির্বাচন পূর্ববর্তী জনমত জরিপেও এগিয়ে আছেন তিনি।
পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা বলছেন, ২০০১ সাল থেকে তিন দফায় থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে তাঁর দল ফিউ থাই যেসব কাজ শেষ করতে পারেনি, এবার তিনি সেই কাজগুলো শেষ করবেন। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, ঋণের বোঝা কমানোসহ আরও নানা প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন নবাগত এই রাজনীতিবিদ।
তাঁর ফুফু ইংলাক সিনাওয়াত্রার নেতৃত্বে ফেউ থাই পার্টির শেষ মেয়াদের ক্ষমতার কথা তুলে ধরে পেতংতার্ন বলেন, ‘প্রথম বছরে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু চার বছরের মাথায় ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়। ফলে সকল লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। জনগণকে এখন বোঝাতে হচ্ছে—আমাদের নীতিগুলো কীভাবে তাঁদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনবে। মানুষের জীবনযাত্রায় টেকসই পরিবর্তনের জন্য স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ থাকাটা একান্ত জরুরি।’
থাইল্যান্ডের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিডার জরিপ বলছে, ৩৬ বছর বয়সী পেতংতার্নের প্রতি ৩৫.৭ শতাংশ মানুষের সমর্থন আছে। এরপর আছেন মুভ ফরওয়ার্ড পার্টির পিতা লিমজারোনরাত (২০.২৫ শতাংশ)। তিন নম্বরে আছেন দেশটির সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চান-ওচা।
থাইল্যান্ডে দীর্ঘদিন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সিনাওয়াত্রা পরিবার। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন থাকসিন সিনাওয়াত্রা। এরপর ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তাঁর বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা।
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২০১৪ সালে ক্ষমতার দৃশ্যপটে আসেন থাইল্যান্ডের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল প্রায়ুথ চান-ওচা। তৎকালীন থাই প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রার সরকারকে উৎখাত করে তিনি সামরিক শাসন জারি করেন। এরপর ২০১৯ সালের এক বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন। সমালোচকদের মতে, ২০১৯ সালের নির্বাচন ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তবে প্রায়ুথ চান-ওচার সরকারের দাবি, ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে।
সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চান-ওচার নতুন দল ইউনাইটেড থাই নেশন পার্টি জেতার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। পালং প্রচারথ পার্টি থেকে বেরিয়ে ইউনাইটেড থাই নেশন পার্টি গঠন করেন প্রায়ুথ। পালং প্রচারথ পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী প্রবিত ওংসুওয়ান। এছাড়াও তাঁদের জোটে রয়েছে সেনাসমর্থিত আরও বেশ কয়েকটি দল।
সুতরাং প্রধানমন্ত্রী হতে গেলে থাকসিন কন্যার দুই হাউস মিলে ৩৭৬ জনের সমর্থন দরকার হবে। ২০১৭ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে নতুন এই নিয়ম আনা হয়। সমালোচকদের মতে, নির্বাচনে সেনাসমর্থিত সরকারকে জয়ী করতেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তবে এক সময়কার সেনাপ্রধান জেনারেল প্রায়ুথ চান-ওচা অবশ্য তাঁর প্রভাব ধরে রাখতে পারেননি। ২০১৪ সালে ক্ষমতা দখল করা প্রায়ুথ চান-ওচার প্রভাব এখন আর আগের মতো নেই। ক্ষমতা দখলের সময় রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানোর কথা বললেও প্রায়ুথ চান-ওচা নিজেই নোংরা রাজনীতিতে জড়ান। তাঁর নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের ধারণা জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। ২০২০ ও ২০২১ সালের দিকে ক্ষোভে রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। থাইল্যান্ডের ক্ষমতাসীন সরকার ও রাজতন্ত্রের সংস্কারের দাবিতে তাঁরা বিক্ষোভ করে।
প্রায়ুথ চান-ওচা সরকারের ওপর যে সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টি রয়েছে সেটির বড় প্রমাণ মেলে ব্যাংককের গভর্নর নির্বাচনে। গত ২২ মে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে গভর্নর নির্বাচিত হন চাডচার্ট সিট্টিপুন্ট। তিনি ইংলাক সিনাওয়াত্রার দল ফেউ থাই পার্টির সদস্য। তিনি ইংলাক সিনাওয়াত্রার সরকারের পরিবহনমন্ত্রী ছিলেন। ব্যাংককের গভর্নর নির্বাচনে সেনা-সমর্থিত সরকারের ভরাডুবি হয়। কিন্তু নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রভাব থাকায় শেষ পর্যন্ত তিনি ফের প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
প্রায়ুথ চান-ওচা, পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা ছাড়াও এবারের নির্বাচনে বেশ জোরালো আলোচনায় আছেন মুভ ফরওয়ার্ড পার্টির পিতা লিমজারোনরাত। তরুণ ভোটারদের টানতে কাজ করে যাচ্ছে দলটি। তাঁরা ভোটারদের ব্যক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিতের আশ্বাস দিচ্ছে। এছাড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে সব সময়ই সরব ছিল দলটি।
গত ২০১৯ সালের নির্বাচনে ফিউচার ফরওয়ার্ড পার্টি ৮১ আসন পেয়ে যে চমক দেখিয়েছিল এবার মুভ ফরওয়ার্ড পার্টি সে রকম চমক দেখাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই নির্বাচনে ফিউচার ফরওয়ার্ড পার্টির সাফল্যের পেছনে তরুণ ভোটারদের অবদান ছিল বলে সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। ফিউচার ফরওয়ার্ড পার্টি থেকেই পরবর্তীতে মুভ ফরওয়ার্ড পার্টি গঠিত হয়।
গত ২০১৯ সালের নির্বাচনে অন্যান্য দলের চেয়ে বেশি আসন পেয়েও সরকার গঠন করতে পারেনি ফেউ থাই পার্টি। কেননা প্রায়ুথ চান-ওচার পালং প্রচারথ পার্টি অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করে ক্ষমতায় আসে। সেই নির্বাচনে এককভাবে ১৩৬ আসনে জয় পেয়েছিল ফেউ থাই পার্টি। তাই এককভাবে বেশি আসন পেলেও বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সরকার গঠন করতে হলে অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোট গঠনের বিকল্প নেই ফেউ থাই পার্টির। ফেউ থাই পার্টির পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা অবশ্য মুভ ফরওয়ার্ড পার্টির সঙ্গে জোট গঠনের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। তবে সেনা সমর্থিত কোনো দলের সঙ্গে জোট গঠনের পরিকল্পনা নেই দলটির।
থাইল্যান্ডের ক্ষমতায় যে দলই আসুক বা যিনিই প্রধানমন্ত্রী হন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। গত এক দশকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে বিদেশি বিনিয়োগ কম পেয়েছে থাইল্যান্ড। দেশটির জীবনযাত্রার ব্যয় এখন অত্যধিক বেশি। বাড়ি ভাড়া আকাশছোঁয়া। নতুন নেতৃত্বের কাছে জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর প্রত্যাশা থাকবে দেশটির জনগণের।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, রয়টার্স, ডয়েচে ভেলে, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, সিএনএ