Ajker Patrika

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের নিবন্ধ /একযোগে দুই পরাশক্তির চাপে ইউক্রেন

হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

বাংলাদেশ সময় গতকাল শুক্রবার রাতে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এটি হোয়াইট হাউসে তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সফর। তাই আনুষ্ঠানিকতার পর্বও ছিল বেশ জমকালো। কিন্তু বৈঠকটি সৌজন্যমূলক কথাবার্তার মাধ্যমে শুরু হলেও কয়েক মিনিটের মধ্যেই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ে রূপ নেয়। এর ফলে ইউক্রেন সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করেছে। এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের জন্য যখন পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন আরও বেশি প্রয়োজন, ঠিক তখনই এ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু বৈঠকের শুরু থেকেই পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব লাভের আশায় থাকা ইউক্রেনীয় নেতা জেলেনস্কি এখন কার্যত উভয়সংকটে পড়েছেন। একদিকে রাশিয়া, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র—এই দুই পরাশক্তির নেতাই যেন তাঁর দেশের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে দুই বৃহৎ শক্তির চাপে পড়ে ইউক্রেন এখন নাস্তানাবুদ।

এই বৈঠকের প্রেক্ষাপট ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেও তাতে ইউক্রেনকে আমন্ত্রণ জানায়নি। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প জেলেনস্কিকে একটি খনিজ চুক্তি করতে চাপ দিয়েছিলেন, যা শুরুতে ছিল একধরনের ব্ল্যাকমেইলের মতো। এর পরপরই ট্রাম্প জেলেনস্কিকে ‘একনায়ক’ বলে অভিহিত করেন।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও মস্কো একসঙ্গে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব পাস করেছে, যেখানে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধে জড়ানোর কোনো দায় নেই, বলে হয়। এতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, ওয়াশিংটন ধীরে ধীরে ইউক্রেনকে ছেড়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে, এ সময়টির জন্য তিন বছর দাঁতে দাঁত কামড়ে ছিলেন পুতিন। তিনি জানতেন, পশ্চিমা বিশ্বের ঐক্যে ফাটল ধরার মুহূর্ত আসবে। এখন মনে হচ্ছে, ওভাল অফিসে ট্রাম্প-জেলেনস্কির বাগ্‌বিতণ্ডা সে সুযোগ করে দিয়েছে।

জেলেনস্কির প্রশাসন কয়েকটি কৌশলগত ভুল করেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

প্রথমত, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি খনিজ সম্পদ চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল, যা কিয়েভের ‘বিজয়’ পরিকল্পনার অংশ ছিল। এর লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনের পক্ষে আরও জোরালো অবস্থান নিতে বাধ্য করা এবং যুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়া।

দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ (Peace Through Strength) নীতির ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল ইউক্রেন।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ট্রাম্প শুধু ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেছেন। বিনিময়ে কিয়েভকে সামান্য কিছু দেওয়ারও আগ্রহ দেখাননি। চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া কিছুটা নমনীয় হলেও এতে কোনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তার উল্লেখ ছিল না। ট্রাম্প দাবি করেছেন, মার্কিন খনিজ অনুসন্ধানকারীরা ইউক্রেনে থাকলে রাশিয়া আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে অনেক মার্কিন নাগরিক ও প্রতিষ্ঠান ছিল, যা রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিহত করতে পারেনি।

জেলেনস্কি এবার শিখলেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের নীতি কী হতে পারে। তাঁর প্রথম শিক্ষা হলো, ট্রাম্পের কাছে ‘শান্তি’ মানে টিভির স্ক্রিন কেবল যুদ্ধের দৃশ্য থেকে সরিয়ে ফেলা। মধ্যপ্রাচ্যে যেমনটি হয়েছে। তিনি এমন একটি যুদ্ধবিরতি চান, যা যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা দেওয়া থেকে রেহাই দেবে। কিন্তু স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধ করার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে তিনি আগ্রহী নন।

দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের প্রধান লক্ষ্য অর্থনৈতিক স্বার্থ। ব্যক্তিগত সম্পর্কও তাঁর সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রাখে। ট্রাম্প এখনো জেলেনস্কির ওপর ক্ষুব্ধ, কারণ ২০১৯ সালে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে চাপ প্রয়োগ করার পর তাঁর বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।

তবে সবচেয়ে রহস্যজনক হলো, পুতিনের প্রতি ট্রাম্পের মোহ। তিনি রুশ প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় পুরোপুরি গ্রহণ করেছেন। পুতিন মনে করেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে মুষ্টিমেয় বৃহৎ শক্তি এবং তাদের শক্তিশালী নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। মূলত উনিশ শতকের এই বিশ্বদর্শন থেকেই পুতিনের প্রতি ট্রাম্পের এই দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেক নেতার নিজস্ব প্রভাববলয় থাকবে, এমন ধারণাও পোষণ করেন ট্রাম্প।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার চলতি সপ্তাহে ট্রাম্পের সঙ্গে সফল বৈঠক করেছেন। জেলেনস্কির কূটনৈতিক দক্ষতা হয়তো এই দুই নেতার মতো নয়। তবে ইউক্রেনের নেতা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন, সেটি একধরনের রাজনৈতিক ‘অ্যামবুশ’ ছিল। আর এখানেই দুই বৃহৎ শক্তির কাছে ধরা পড়ে নাস্তানাবুদ হয়েছেন জেলেনস্কি।

তিন বছর আগে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার হামলা চালিয়েছিল রাশিয়া। এখন এই যুদ্ধের ভাগ্য সম্ভবত সবচেয়ে অনিশ্চিত পর্বে প্রবেশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আনুগত্য হারিয়ে ইউক্রেনকে এখন কঠিন এক লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত