ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ২০ বছরেও ফুরিয়ে যায়নি তালেবানরা। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর অব্যাহত অভিযানেও নির্মূলের বদলে তারা হয়ে উঠেছে আরও শক্তিশালী। ন্যাটো বলছে, ক্ষমতাচ্যুতির পর তালেবানের পূর্ণকালীন যোদ্ধা বেড়ে বর্তমানে ৮৫ হাজারে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সেনা সরিয়ে নিতেই আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে তালেবানরা। এরই মধ্যে ইরান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা দেশটির সীমান্তবর্তী এলাকা দখলে নিয়েছে তারা। তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে সরকারি বাহিনীর খাবি খাওয়া দেখে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে—প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির বিদায়ের ঘণ্টা বাজল নাকি?
শুরুতে তালেবানদের সাদরেই গ্রহণ করেছিল আফগানিস্তানের জনতা। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পর ১৯৯৪ সালে উত্তর পাকিস্তানে ‘তালেবান’ দলের উৎপত্তি। উৎপত্তির পরই তালেবানরা ক্ষমতা পেলে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পশতুন অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ঘোষণা দেয়। দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তান থেকে তারা বাড়াতে থাকে প্রভাব। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমে ইরানের সীমান্তবর্তী হেরাত ও পরের বছর আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখল করে নেয়। তালেবানরা আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট বোরহানউদ্দিন রাব্বানিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ১৯৯৮ সালে দখলে নেয় দেশের ৯০ শতাংশ এলাকা। এই এলাকাগুলোয় দুর্নীতি দমন, আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তালেবানরা। সব মিলিয়ে যুদ্ধ, মুজাহিদীনের বাড়াবাড়ি ও অন্তর্কোন্দলে বিরক্ত আফগানরাও তালেবানদের সাদরেই গ্রহণ করে।
কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তালেবানরা ইসলামি শাসনের নামে কঠোর ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। হত্যাকারী ও ব্যভিচারীদের প্রকাশ্যে হত্যা, চুরির অপরাধে হাত কাটার মতো শাস্তির প্রয়োগ নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। নারীদের বোরকা পরা, পুরুষদের দাড়ি রাখাকে করা হয় বাধ্যতামূলক। নিষিদ্ধ হয় টেলিভিশন, গান, সিনেমা, ১০ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়া। এসব পদক্ষেপ দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হলেও গোষ্ঠীটি সবচেয়ে বেশি সমালোচনায় আসে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট আফগানিস্তানে হামলা চালায়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এই জোটের হাতে তালেবান শাসনের পতন ঘটে।
ক্ষমতার পতনে তৎকালীন নেতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমর, ওসামা বিন লাদেনসহ অনেকেই পালিয়ে যান। তবে মিলিয়ে না গিয়ে টিকে থাকার লড়াই অব্যাহত রাখে তালেবানরা। শুধু টিকে থাকাই নয়, বিদেশি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে জিতেও যাচ্ছিল। ২০১২ সালে ন্যাটোর ক্যাম্প ব্যাস্টিয়ন ঘাঁটিতে শক্তিশালী হামলার পর ২০১৩ সালে দেয় কাতারে দপ্তর খোলার ঘোষণা। এর মধ্যে ২০১১ সালে বিন লাদেনের মৃত্যু, হাসপাতালে মোল্লা ওমরের মৃত্যু, ২০১৬ সালে ড্রোন হামলায় প্রধান নেতা মোল্লা মনসুরের মৃত্যুর মধ্যেও এগিয়ে যায় তালেবান সেনারা।
আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ বাঘিসের রাজধানী কালা-ই-নাওয়া পুনর্দখল করলেও উদ্বেগে রয়েছে আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনী। একটি তালেবান হামলা থেকে বাঁচতে এক হাজারের বেশি আফগান সেনার প্রতিবেশী তাজিকিস্তানে সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সেনা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে সমালোচনা হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে ৮ জুলাই বিস্তারিত জানাতে হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেখানে তিনি বলেন, সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সঠিকই হয়েছে। এতে আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে যে সেনা প্রত্যাহারের কথা ছিল, তা ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে করা হবে বলে জানান তিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে একটি গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করছে মার্কিন ও আফগান নিরাপত্তা বাহিনী। সব মিলিয়ে আফগানিস্তানের মানুষের মধ্যেও একধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও তারা বলছে, ‘জোর করে কাবুল দখল তাদের লক্ষ্য নয়।’
কিন্তু এই ভাষ্যের বদলে সবাই পরিস্থিতির দিকেই তাকিয়ে এখন। পরিস্থিতি বলছে, কাবুলের দিকেই তাদের নজর। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদনেও এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বালাখের ১৮ বছর বয়সী স্কুলছাত্র আমির মোহাম্মদীর বরাত দিয়ে বলা হয়, বন্দুকধারীদের আকস্মিক উপস্থিতি স্পষ্ট বলছে, ‘বিপদ নিকটবর্তী।’
কাগজ-কলমে আফগান সেনাবাহিনী ও পুলিশ তালেবানদের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু এখন তাদের থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, তথা ন্যাটোর সমর্থন মাথার ওপর থেকে সরে যেতেই তাদের শক্তির স্বরূপটি প্রকাশ্যে চলে এসেছে। অবশ্য এ অবস্থাটি এখনো স্বীকার করতে রাজি নয় কাবুলের সরকার। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে তালেবানদের কাছ থেকে কিছু এলাকা পুনরুদ্ধারের খবর ফলাও করে প্রচার করছে তারা। এদিকে তালেবানরা তাদের লক্ষ্যে এগিয়েই যাচ্ছে। মাঝখানে ইতিবাচক প্রচারণাও শুরু করেছে তালেবানরা। তাদের কাছে যারা আত্মসমর্পণ করেছে, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার নানা ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করছে। নিশ্চিতভাবেই এটি তাদের জনমুখী ভাবমূর্তি তৈরির কৌশল।
আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ বলা যায় এখন এক শাঁখের করাতের ওপর রয়েছে। তালেবান শাসনের ফিরে আসা তাদের চোখ রাঙাচ্ছে। আশ্রয় নেওয়ার জন্য তারা আফগান সরকারের ওপর আস্থাও রাখতে পারছে না। এমনকি মুখে যা–ই বলুক আফগান সরকার নিজের শক্তি ও সামর্থ্যের ওপর নিজেও খুব একটা আস্থা রাখতে পারছে না। আবার যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো বাহিনী দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের ব্যয় টানতে টানতে নাকাল। ফলে শান্তির ধ্বজা উড়িয়ে তাদের আফগানিস্তান ত্যাগই দস্তুর। এ ক্ষেত্রে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের খবরে তালেবানদের বিজয় উদ্যাপনও তাদের পিছু টেনে ধরতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা দেশত্যাগ করতে চায়, তারাও সহজে তা করতে পারছে না। শুধু করোনা নয়, এ ক্ষেত্রে দেশটির পরিস্থিতিই তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশ এই মহাদুর্যোগের সময়ে আফগানিস্তান থেকে অভিবাসী স্রোত থামাতে দেশটিতে তাদের কনস্যুলেট বন্ধ করে দিয়েছে। এ তালিকায় প্রতিবেশী দেশগুলোই রয়েছে শুরুতে। পরিস্থিতি আরও জটিল হলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তালেবানদের শাসন যেমন, তেমনি নাইন–ইলেভেনের পর এক মেরু বিশ্বের অধিপতি মার্কিন নিষ্পেষণ দেখেছে আফগানিস্তান। দেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র রপ্তানির কৌশল। আর এ সবের জন্য তাদেরই বারবার মূল্য চোকাতে হয়েছে। ক্ষমতার লড়াইয়ে তারা বারবার নিজেকে হেরে যেতে দেখেছে। এবার মার্কিন সেনা প্রত্যাহার তারা দেখল, একই সঙ্গে দেখল শঙ্কার কালো মেঘ ঘনিয়ে আসতে। সেনা মোতায়েন ও সেনা প্রত্যাহারের পেছনে থাকা বাণিজ্যিক সম্বন্ধটির খোঁজ রাখার বদলে, তারা এখন ছুটছে আশ্রয়ের খোঁজে। বিদেশি সেনাদের চলে যাওয়া যেকোনো দেশের মানুষের জন্যই আনন্দের মুহূর্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আফগানদের ভাগ্য এমন নয়। তারা বরং বাঘের মুখ থেকে ঘোগের বাসায় ঢুকে পড়ার ভাগ্য নিয়ে এসেছে। এখন পর্যন্ত এই ভাগ্যে তেমন কোনো বদলের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।