হোম > শিল্প-সাহিত্য

আসাদ চৌধুরী: নতুন পথের সন্ধানী

আকিফ গালিব

‘তবক দেওয়া পান’ কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদ চৌধুরী ৫ অক্টোবর, ২০২৩ স্থানীয় সময় রাত পৌনে ৩টার দিকে টরন্টোর অদূরে আসোয়া শহরের লেকরিচ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যু শব্দটির সাথে স্তব্ধ হয়ে গেল কাঁধে ঝোলা, পানের রঙে রঞ্জিত লাল ঠোঁটে সদা হাস্য একজন কবির দিলখোলা হাসির অনুরণন। বাংলা একাডেমি একুশে বইমেলায় প্রথম পরিচয়, কবিতায় চিনি তাঁকে আরও বহু বছর আগে—
গোলাপের মধ্যে যাব। 
বাড়ালাম হাত
ফিরে এলো রক্তাক্ত আঙুল। 
সাপিনীর কারুকার্য
নগ্ন নতজানু
চরাচরে আবেগ বিলায়। 
আমার অধরে শুধু
দাঁতের আঘাত। 

চাঁদের ভেতরে খাদ্য
আমাকে কেবল
নিয়ে যায়
নিঅনের কাছে
হায় দেহ, শুধুই শরীর
বিদ্যুৎবিহীন। 
(আত্মজীবনী: ১)
‘তবক দেওয়া পান’ কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে যেমন লিখেছিলেন—‘আমার গোটা শরীর কিছুতেই ঘরে আসতে চায় না, হয়তো সবটা দেহ কোনো দিন ঘরে ফেরেনি। এটা আমি আগে টের পাইনি, আর পেলেই বা কি হতো? চিকিৎসার জন্য আমি তো আর ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি না সাহানা, তোমার কাছেই এসেছি। এবার দ্যাখো তো আমার শরীরের কিছু অংশ বাইরে কোথাও ফেলে এলাম কি না?’ প্রথম পরিচয়ের দিন জেনেছিলাম উৎসর্গপত্রে লেখা কথাগুলো কতটা ধ্রুব সত্য সদা গাল্পিক প্রাণময় মায়াময় আড্ডাবাজ কবির জীবনে। সত্যিই বাহির তাঁকে পাগল করে রাখে। ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতায় যে স্বর, কবিতার বিনির্মাণে যে ঝাঁজালো শব্দগুচ্ছ, রাগ, ঘৃণা আর অস্থিরতা সেই পথ অবলীলায় ফেলে এসে আসাদ চৌধুরী নতুন পথের সন্ধান করেছেন। তিনি গতানুগতিকতার ভেতর থেকে সচেতনভাবেই বাইরে আসার দৃষ্টান্ত হয়ে নিজের সময়-পর্বে চিহ্নিত হয়েছেন। হতাশা, অবক্ষয় আর জীবনসংঘাতকে পরিপূর্ণ করে প্রকাশের বেদনায় নীলকণ্ঠ হয়ে তিনি ব্যক্তির অনুভূতিপুঞ্জকে নিজের মতো সাজিয়ে তুলেছেন। একমুখী প্রচলের মধ্য থেকে বেরিয়ে, তবে তাকে অস্বীকার করে নয়, বরং আত্মস্থ করে স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আসাদ চৌধুরী ষাটের দশকের কবিতায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন।
কবিকে পলায়নবাদী মনে হতে পারে, মনে হতে পারে সমকালকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন? একজন কবি ও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ভুলে থাকতে চেয়েছেন সময়, অন্ধকার থেকে পালিয়ে থাকতে চেয়েছেন? মিলান কুন্ডেরার একটি কথা কোথায় যেন পড়েছিলাম, ‘উপন্যাস বা শিল্প হলো বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম।’ আমার মনে হয়, আসাদ চৌধুরী ঠিক তেমনি একজন কবি, যিনি কবিতার মধ্যে দিয়ে জারি রেখেছেন সে সংগ্রাম। আসাদ চৌধুরীর কবিতা স্পষ্ট করে—তিনি জীবন ও শিল্পচেতনার সমন্বয় খুঁজেছেন। তিনি নিরাসক্ত নন, তবে তার আসক্তি প্রমাণের জন্য তিনি ঝাঁ-চকচকে, রাগী শব্দ ব্যবহার করেননি। তিনি শিল্প বিনির্মাণের প্রশ্নে মনোযোগ দিয়েছেন মননশীলতার দিকে। সেখানে উচ্চকিত এবং জোরালো ভাবের ব্যবহার নিশ্চিত করলেও বর্ণনার প্রশ্নে তিনি ধীরস্থির। সেই স্থিরতা কিন্তু তার আবেগ, তার প্রকাশকে বাঁধতে পারেনি বরং সেই স্থিরতার ভেতর দিয়েই তিনি নিজের বলিষ্ঠ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন; যা তাঁকে দিয়েছে ধ্যানীর মগ্নতা। তাই হয়তো তিনি বলতে পারেন—
‘তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?’ 

(শহীদদের প্রতি) 

আসাদ চৌধুরীর কবিতা অবদমিত ইচ্ছার কাছে হেরে না গিয়ে সময়কে বিবৃত করেছে। সময়ের মধ্যে থেকেই সময়কে আত্মস্থ করে চেতনাস্রোতকে প্রবাহিত করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর কবিতার শক্তিশালী দিক শব্দ ব্যবহার, যা পাঠককে বিব্রত করে না, বরং কাছে টানে। সেই সহজসরল শব্দের পিঠে শব্দ জুড়ে জুড়ে তিনি দক্ষ কারিগরের মতো সমাজজীবনের এবং ব্যক্তিমানসের অন্তর্বেদনার ছবি আঁকেন। যেখানে শব্দের নিজস্ব গতির বাইরে এসে তার শব্দেরা খেয়ালি মনের বর্ণনায় মেতে ওঠে। স্মরণযোগ্যতার বিন্দুবিভা ছড়িয়ে যায় বাঙালির হৃদয়জুড়ে: 
‘দিন যায়, 
দিন যেতে থাকে। 
তাঁর জন্যে যত শ্রদ্ধা নিজেদের প্রতি ততখানি ঘৃণা, 
কারাগার তাঁকে চেনে, 
ঘাতক বুলেট তাঁকে চেনে
শুধু অকৃতজ্ঞ আমরা চিনি না।’ 

(স্মরণের মীঢ়ে ধীরেন) 

ষাটের দশকে বাংলাদেশে যেসব কবিতা লেখা হয়েছে, তার প্রায় সবই বিবৃতিমূলক, কবিতার শরীরে প্রচুর মেদ, অধিক কথা, ত্রিশের দশকের বাংলা কবিতার স্ফুরণ ঘটেছিল রবীন্দ্রবিরোধিতার মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর প্রভাবকে অস্বীকার করে কাব্য রচনার মধ্য দিয়ে কবিতাকে আধুনিকতার ফ্রেমে ফেলার স্বেচ্ছা-উদ্যোগের ধারা পরবর্তীকালেও চলে আসে। ষাটের দশকের যে অস্থির সময়-পর্ব, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংঘাতের মধ্যে দিয়ে একটি নতুন স্বপ্নের আশায় মানুষ নৈরাশ্য, দ্বন্দ্ব এবং সংশয়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। সেই জটিল সময়াবর্তের ভেতর রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে রাবীন্দ্রিক শব্দপুঞ্জকে ক্রিয়াশীল রেখে শুরু থেকেই আসাদ চৌধুরী নিজেকে ব্যতিক্রম করে তুলতে চেয়েছেন। আসাদ চৌধুরীর কবিতা বিবৃতিময় না। তিনি অল্প কথায়, সীমিত শব্দের বন্ধনে ভাবকে মুক্তি দেন। অতীত এবং ভবিষ্যতের মাঝে দাঁড়িয়ে সেতুবন্ধনের সূত্র খোঁজেন। সেই সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রপ্রভাবকে স্বীকার করে, আত্মস্থ করে ব্যক্তিত্ববোধকে নির্মাণ করেন। যখন নিজেকে প্রকাশের, আত্মবিবৃতির মধ্য দিয়ে মানুষ মুক্তি দিতে চাইছে ভাবনাকে। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত শব্দে, উপমায়, বর্ণনায় বারবার ঘুরে আসে রাবীন্দ্রিক আবহ। যেখানে উজ্জীবিত হওয়ার মতো উপাদান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে কবির চেতনার মুক্তি অন্বেষাও। সময়ের সঙ্গে অঙ্গীভূত যে লোকাচার-লোকাভ্যাস লুপ্তপ্রায়, তাকে স্মৃতিতে জায়মান রাখেন কবি কবিতার রূপকে। 

কোথায় পালালো সত্য? 
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো
রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে, 
গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে, 
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে, 
নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো। 

গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো, 
চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ, 
সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা, 
জর্দার শিশি, লক্ষ্মীর সরা, 
নকশী পাতিল, চৌকির তলা, 
সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো! 

(সত্য ফেরারী) 

কবিতা সম্ভাবনার কথা বলে, আশাবাদী হতে শেখায়, অনুসন্ধানী হতে উৎসাহী করে তোলে। আসাদ চৌধুরীর কবিতা এড়িয়ে যাওয়ার মন্ত্রণা দেয় না, বরং তার পরিণতিকে প্রকাশ করে। ফলে তার কবিতা একান্তভাবে ব্যক্তিআশ্রয়ী হয়ে পড়ে না। ব্যক্তির বিবর্তনকে প্রাধান্য দিলেও তাঁর কবিতায় মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানুষের বস্তুগত অবস্থান। তাই সুয়োরানি রাজধানী ও কেন্দ্রের দাপটে ম্রিয়মাণ মফস্বলের কথা তাঁর কবিতায় নিখুঁত বুননে কথা বলে ওঠে। 
‘মফস্বল, হায় দুয়োরানী, 
চেয়ে আছ সামনের দিকে, হাতে এখনো
পানের বাটা
আর নস্যির কৌটো। 
একটি চোখে অতীতের সোনালি আভা, 
একটি চোখে, ক্লান্ত চোখে, 
ভবিষ্যতের একঘেয়ে স্বপ্ন, 
বর্তমানকে ভোলার কী চমৎকার দাওয়াই
কী বিপুল মেধা নিয়ে, সুযোগের অপেক্ষায় আছ, 
মফস্বল, আমার দুঃখিনী মা। 
মেলোডির মতো শান্ত, স্নিগ্ধ
মফস্বল তোমার কী হলো?’ 

(মফস্বল, হায় দুয়োরানী) 

কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘কবি কোনো হাটে বসে কবিতা লেখেন না। তাঁর কবিতায় হাটের কোলাহল ভেসে আসতে পারে, থাকতে পারে মাঠের উদার শোভা, কিন্তু কবিতা নির্জনতারই প্রসূন। অর্থাৎ কবি যখন কবিতা লেখেন, তখন তিনি নিঃসঙ্গ। কিন্তু এই নিঃসঙ্গতা তাঁকে তাঁর সময় ও সমাজ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন করে না।’ আসাদ চৌধুরীর কবিতার ক্ষেত্রে এই কথা যেন ধ্রুবতারার মতো সত্য। আর তাই হয়তো নিঃসঙ্গ নাগরিক আসাদ চৌধুরী যখন কবি আসাদ চৌধুরী, তিনি তখন তাঁর বুকের মধ্যে ধারণ করেন এক গ্রামীণ পটভূমি। যেখানে আছে নদী, গাছের শ্যামল ছায়া, প্রাচীন জনপদ, সেই জনপদের মানুষ, তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনাসহ জীবনের বিচিত্র সব সম্ভার। সেখানে নানা রঙের সুর আছে, আছে নানাবিধ স্বর। আর সবকিছুর ওপরে আছে তাঁর নিজের একান্ত ব্যক্তিগত ধর্ম, নিজস্ব বাঙালিয়ানা। আরও আছে সৌন্দর্যের মায়াময় স্পর্শ, আছে ধ্বনির বৈচিত্র্য, রসময় অভিঘাত। 

ঠিক আছে
হাত ছেড়ে দিচ্ছি। 
ঠিকই বুঝেছ
টাকার এপিঠ ওপিঠের চেয়ে ঢের সত্য
আমার নিজের ধর্ম, 
আমার বাঙালিয়ানা। 
(‘ঠিক আছে’) 
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কবিতা আসলে ভালোও নয়, মন্দও নয়, কবিতার রস গ্রহণের মধ্যে আছে স্বীকৃতি।’ আসাদ চৌধুরীর কবিতায় বহুকৌণিক ব্যাখ্যা এবং দ্যোতনা যেমন স্পষ্ট, তেমনিভাবে তার সত্য আবিষ্কারের নেশাও দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। শহরকেন্দ্রিক জীবন, যেখানে মানিয়ে নেওয়া, খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠতে থাকে বিচ্ছিন্নতাবোধ, যা মানুষকে করে তোলে স্মৃতিকাতর, আবেগায়িত। মানুষ ফেলে আসা সময়, গ্রাম যাকে যে ধারণ করে বুকের নিভৃতে তার জন্য বিপন্ন বোধ করে, সেই নিঃসঙ্গ, সেই সংকটায়িত জীবনের দিকে বা বিচ্ছিন্নতাবোধকে আসাদ চৌধুরী সঙ্গী করেন না। তিনি নৈরাশ্য বা সংশয়কে অতিক্রম করে সচেতনভাবেই হয়ে ওঠেন জীবনের গুণগ্রাহী। কবির কাব্যপ্রত্যয় ব্যক্ত করে উচ্চারিত হয়—

শব্দ আর রঙ নিয়ে
এইসব মূলধন করে
তবু
কেউ কেউ পথের সন্ধানে নামে। 

(পথের কাব্য)

প্রকাশিত হলো হিমালয় পাই এর নতুন বই ‘ডিটাচমেন্ট টু ডিপার্চার’

জাতীয় কবিতা উৎসব ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি

বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ-পুরস্কার পাচ্ছেন যাঁরা

বামিহাল সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন ৭ জন

ভেন্যু বরাদ্দ বাতিল, অনিশ্চয়তায় এবারের ফোক ফেস্ট

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত

‘পঞ্চাশ বছর ধরে লিখছি, কিন্তু আমি ব্যর্থ’, স্বেচ্ছা অবসর জয় গোস্বামীর

চিত্র চেতনায় চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান, বিজয় দিবসে প্রদর্শনী

‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে’

শিল্পকলায় মুগ্ধতা ছড়ালেন দড়াবাজরা

সেকশন