৬৫৬ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ জিল বাংলা চিনিকলে আখ মাড়াই শুরু হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে চিনিকলের ডোঙায় আখ নিক্ষেপের মাধ্যমে চলতি আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন করা হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. লিপিকা ভদ্র।
জিল বাংলা চিনিকল সূত্রে জানা যায়, ৬৬ মাড়াই মৌসুমের ৪৮ মাড়াই মৌসুম লোকসান গুনেছে চিনিকলটি। গত ৬৬ বছরে ৬৫৬ কোটি ৭৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫ টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়েই এবার চিনিকলটি ৬৭তম আখ মাড়াই মৌসুম শুরু করেছে। ৭৯ কার্যদিবসে ৭১ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৭ রিকভারিতে ৪ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত ২০২৩-২৪ মাড়াই মৌসুমে চিনিকলটিতে ৪১ দিনে ৪৫ হাজার টন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন করে ২ হাজার ৭১৭ টন। চলতি ২০২৪-২৫ মাড়াই মৌসুমে ৭০ দিনে ৬০ হাজার টন আখ মাড়াই করে ৪ হাজার ২০০ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে চিনিকলটির কর্তৃপক্ষ।
প্রশ্ন উঠেছে, আর কত লোকসানের পর লাভের মুখ দেখবে জিল বাংলা চিনিকল? নাকি লোকসান গুনতে গুনতে একসময় বন্ধ হয়ে যাবে পশ্চিম জামালপুরের একমাত্র ভারী এই শিল্পপ্রতিষ্ঠান? এমন প্রশ্ন বহু আগে থেকেই উঠেছে চিনিকলপাড়ায়। তবে চিনিকলটিকে বহুমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ার মাধ্যমে লোকসান ঠেকানো সম্ভব বলে মনে করেন বেশির ভাগ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
মিল সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের যৌথ কারিগরি সহায়তা ও অর্থায়নে চিনিকলটি স্থাপিত। চিনিকলের বার্ষিক চিনি উৎপাদনের ক্ষমতা ১০ হাজার ১৬০ মেট্রিক টন। দৈনিক আখ মাড়াইয়ের ক্ষমতা ১ হাজার ১৬ মেট্রিক টন। দৈনিক আখ মাড়াই সম্ভব হয় ৮৭৪ দশমিক ৯৭ মেট্রিক টন পর্যন্ত। মিলটির সর্বোচ্চ কার্যদিবস ছিল ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে ২১১ দিন। সর্বনিম্ন কার্যদিবস ২০২২-২৩ মৌসুমে ৪১ দিন। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ মৌসুমে ১০১ দিন কার্যদিবস ছিল।
চিনিকলের আগের রেকর্ড ঘেঁটে দেখা যায়, ২৭ মৌসুম ১০০ দিনের ওপর, ৯ মৌসুম ১৫০ দিনের ওপর এবং একটি করে মৌসুম ১৯০ ও ২০০ দিনের ওপর কার্যদিবস সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে কোনোভাবেই ১০০ কার্যদিবসে পৌঁছাতে পারছে না। কার্যদিবস কমে আসার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা গিয়েছে আখের সংকট।
জিল বাংলা চিনিকল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রায়হানুল হক রায়হান বলেন, চিনিকলটিতে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ, সফট ড্রিংকস, স্পিরিট বার্নিশ, কম্পোস্ট সার, পানি বোতল জাতকরণ ইত্যাদি উৎপাদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হলে প্রতিষ্ঠানটি ধারাবাহিকভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, ‘প্রান্তিক চাষির চেয়ে বর্গাচাষির সংখ্যা এখন বেশি। আগে প্রান্তিক চাষিরা আখ চাষ বেশি করতেন। এখন বর্গাচাষিরা বেশি আখ চাষ করেন না। তবে কৃষকদের আখের চাষ বাড়াতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তবে চিনিকলটিতে বাই প্রোডাক্ট চালু করার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা বা প্রস্তাব হয়নি।’
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. লিপিকা ভদ্র বলেন, ‘জিল বাংলা চিনিকলটির লোকসান ও ঋণের বিষয়টি সমাধানে যথেষ্ট চেষ্টা চলছে। আশা রাখি, লোকসান কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।’
এর আগে চিনিকলের ক্যান ক্যরিয়ার প্রাঙ্গণে চলতি আখমাড়াই মৌসুমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন চিনিকলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন—জিল বাংলা চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন। চিনিকলের ডিজিএম (সম্প্রসারণ) মো. আলাউদ্দিনের সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হাসান, জামালপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)-২ শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোহেল রানা, দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বাবু শ্যামল চন্দ, পৌর বিএনপির আহ্বায়ক মনজুরুল ইসলাম, সদস্যসচিব আতিকুর রহমান সাজু, উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর জয়েন্ট সেক্রেটারি ইসমাইল হোসেন এবং জিবাচিক ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি দলিলুর রহমান।