মহিউদ্দিন রানা, ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ)
ইটের সলিংয়ের ওপর প্লাস্টিকের বস্তা বিছানো। বস্তার ওপর থরে থরে সাজানো বিভিন্ন প্লাস্টিক ও কাচের বোতল। পাশেই মোড়ার ওপর বসে আছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব মনতুস সাহা। প্রথমে দেখে যে কারও মনে হতে পারে বোতল ভর্তি তেল অথবা মালিশের ওষুধ। তবে কৌতুহলবশত কাছে গিয়ে জানা গেল ওসব বোতল দাঁত তোলার ও এ কাজে লাগানোর উপকরণ। সম্প্রতি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে দেখা মেলে এসবের।
দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে দাঁত তোলা ও লাগানোর কাজ করছেন মনতুস সাহা। তাঁর বাবা বিনদ চন্দ্র সাহাও এই পেশায় ছিলেন। রুটি-রুজির তাগিদে কিশোর বয়সেই বাবার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এই পেশায়।
বাবার কাছ থেকে দাঁতের কাজ শিখেছেন মনতুস সাহা। তাঁর বাবা মারা গেছেন ১৪ বছর আগে। বাবার পেশাকে সম্মান জানাতে এই ধরে রেখেছেন মনতুস।
আজকের পত্রিকার প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় মনতুস সাহার। আলাপের সময় মনতুস জানান, তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জের রাজিবপুর ইউনিয়নের মাইজহাটি গ্রামে।
মনতুসের সংসারে স্ত্রী ছাড়াও দুই ছেলে এক মেয়ে রয়েছেন। নিজে দাঁত তোলা-লাগানোর কাজে থাকলেও এই কাজে দুই ছেলেকে ভিড়তে দেননি তিনি। খেয়ে-না খেয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে সরকারি চাকরিজীবী বানিয়েছেন বলে জানান তিনি।
মনতুস জানান, বড় ছেলে কার্তিক চন্দ্র সাহা বিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) পোস্টে চাকরি করেন। ছোট ছেলে গণেশ চন্দ্র সাহা কিশোরগঞ্জ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নকলনবিশে আছেন। মেয়ে জ্যোৎস্না রাণী সাহাও কিশোরগঞ্জ জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী (পেশকার)।
মনতুস জানান, এক সময়ে গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ দাঁতের কোনো সমস্যা হলে তাঁর কাছে আসতেন। এখন আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও যন্ত্রপাতি আসায় তাঁর কাজ কমে গেছে। মানুষ তেমন আর আসে না তাঁর কাছে। মাঝে-মধ্যে যারা আসে তাঁদের কাজ করেই স্বস্তি পান তিনি। তাঁদের কেউ ১০০, কেউ ২০০ আবার কেউ বেশি টাকাও দিয়ে যান তাঁকে। গরিব-অসহায়দের বিনা পয়সায়ও কাজ করে দেন মনতুস।
কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই দাঁত তোলা-লাগানোর কাজ করছেন, এতে কারও কোনো সমস্যা হয়েছে? মনতুস বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর হতে চলেছে এই পেশায়, এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি।’
মনতুসের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখা গেছে, আবদুল মোতালেব (৮০) লাঠিতে ভর করে এসে মনতুসের পাশে বসেন। দাঁতের সমস্যার কথা বলতেই মনতুস চিকিৎসা শুরু করেন। জানতে চাইলে আজকের পত্রিকাকে আবদুল মোতালেব বলেন, ‘মানুষ কয় দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝে না কেউ। কথাডা যে সত্য তা বুড়া বয়সে টের পাইতাছি। বয়সের বাড়ার লগে লগে দাঁত বেশি অর্ধেক পইড়া গেছে গা। যেইডি আছে হেইডিও লড়ে। বেদনা করে। অহন মনতুসের চিহিৎসায় ভালা আছি।’
স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে মনতুস এই অঞ্চলে দাঁত তোলা ও লাগানোর কাজ করছেন। কাগজপত্রে সনদ না থাকলেও দাঁতের বিভিন্ন সমস্যায় মনতুসের চিকিৎসা খুবই ভালো।