ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির ধারায় হঠাৎ আশঙ্কাজনক হারে কমছে সিমেন্টের চাহিদা। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমেছে। তাতেই শিল্পটি প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে ঋণাত্মক ধারার মুখে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একদিকে কোম্পানিগুলোর অসম প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসা নতুন সরকার মেগা প্রকল্প নেয়নি। বরং আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নেওয়া প্রকল্পগুলের বেশির ভাগ বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগও কমেছে। এককথায় সিমেন্ট খাত স্থবির রয়েছে। ফলে এ খাতে নতুন কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ রয়েছে, তাতে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০২০ সালের করোনার ধাক্কা কাটতে না কাটতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়। এই মন্দার ধাক্কা পড়েছে নির্মাণ খাতে। একদিকে ডলার-সংকট, অন্যদিকে কাঁচামাল আমদানিতেও খরচ বেড়েছে। এর সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে এ খাতে।
জানতে চাইলে আমান সিমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) খন্দকার কিংশুক হোসেইন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ৫ আগস্টের পর ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন, কিংবা বড় বড় স্থাপনার কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে যেখানে বছরে শিল্পের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০-১২ শতাংশ, সেখানে গত চার মাসে ৪-৫ শতাংশ ঋণাত্মক হয়েছে। কারখানাগুলো সক্ষমতার ৫০ শতাংশ উৎপাদন করছে।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) তথ্যমতে, দেশে ৩০টি বড় কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানির ৪০টি কারখানা রয়েছে। চলতি বছর কারখানাগুলো ৪ কোটি টন সিমেন্ট উৎপাদন করেছে। বিপরীতে এ সময়ে চাহিদা ছিল ৩ কোটি ১১ লাখ টন।
এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২৩ সালের কোম্পানিগুলোতে সিমেন্ট উৎপাদিত হয়েছিল ৩ কোটি ৮৫ লাখ টন; আর গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত একই সময়ে হয়েছে ৩ কোটি ১৮ লাখ টন। অর্থাৎ ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের একই সময়ে সিমেন্ট বিক্রি কমেছে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
তবে কোম্পানিগুলোর পরিসংখ্যানমতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর ২ কোটি ৭২ লাখ ৬৮ হাজার ৪২ টন সিমেন্ট বিক্রি হয়েছে; যা ২০২৩ সালে ছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫১৬ টন। অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে সিমেন্ট বিক্রি। ২০২২ সালে ছিল ৩ কোটি ৮৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭১ টন এবং ২০২১ সালে ছিল ৩ কোটি ৯১ লাখ ৭৬ হাজার ৪৩৮ টন।
জুলাই-অক্টোবর সময়ে মুনাফা কমেছে অধিকাংশ কোম্পানির
চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সাতটি কোম্পানির মধ্যে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) কমেছে ৬টির। এগুলোর মধ্যে দুটি কোম্পানি মুনাফা থেকে লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে মুনাফা বেড়েছে একটি কোম্পানির।
প্রতিষ্ঠানটি হলো কনফিডেন্স সিমেন্ট পিএলসি। জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯৬ টাকা; যা ২০২৩ সালে ছিল ২ দশমিক ১৬ টাকা।
একই খাতের আরেক কোম্পানি ক্রাউন সিমেন্ট পিএলসি। প্রতিষ্ঠানটির প্রতি শেয়ারে আয় হয়েছে ২৫ পয়সা; যা ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ২ টাকা ৩২ পয়সা। গত তিন মাসে লোকসান কিছুটা কমেছে আরামিট সিমেন্ট লিমিটেডের। সর্বশেষ তিন মাসে এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়িয়েছে ২ টাকা ২৩ পয়সা; যা ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ৪ দশমিক শূন্য ২ টাকা।
একই সময়ে মুনাফা থেকে লোকসানের মুখে পড়েছে মেঘনা সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের শেয়ার। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৩ দশমিক ২৯ টাকা; যা ২০২৩ সালে ছিল ১৩ পয়সা। প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলসের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ১৪ পয়সা; যা ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ৫৪ পয়সা।
বহুজাতিক কোম্পানি হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেডের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১৪ পয়সা। অথচ ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৪৮ পয়সা। এ ছাড়া লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের শেয়ারপ্রতি আয় ৭৬ পয়সা; যা ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ১ দশমিক ৩৮ পয়সা।
কেন কমছে সিমেন্ট বিক্রি
সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তারা বলছেন, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫ থেকে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে সিমেন্ট খাতে। কিন্তু তারপর থেকে এই খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে; বিশেষ করে চলতি বছরের জুলাইয়ের পর থেকে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তার পেছনে থাকা কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ইস্যু। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সরকারি প্রকল্পের স্থবিরতা, কমেছে নতুন প্রকল্প এবং বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ইকবাল চৌধুরী বলেন, প্রতিনিয়ত রাস্তায় আন্দোলন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় সিমেন্টের চাহিদা প্রায় অর্ধেক কমেছে। গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঠিকাদারেরা পালিয়ে যাওয়ায় অনেক সরকারি প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি খাত থেকে সিমেন্টের চাহিদা কমেছে; যা বার্ষিক সিমেন্ট ব্যবহারের ৩৫ শতাংশ।
সুদিনে ফিরতে যা প্রয়োজন
ঋণাত্মক ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে সিমেন্ট খাতে নীতিসহায়তা দিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা থাকতে হবে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) ভাইস চেয়ারম্যান আলমগীর কবির আজকের পত্রিকাকে বলেন, সিমেন্ট খাতে এখন দুর্দিন যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প বাড়াতে হবে। নতুন করে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে হবে।
বিশ্বে অবস্থান
গ্লোবাল সিমেন্ট প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বিশ্বে ৪১২ কোটি ৯০ লাখ টন সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়। তখন উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৬১৩ কোটি ৮০ লাখ টন। বাজারের আকার ছিল ৩৯৫ বিলিয়ন ডলার বা ৩৩ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এই আকারের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম। দুই বছর আগেও যা ছিল ২৩তম। দেশভিত্তিক সিমেন্ট ব্যবহারে শীর্ষে রয়েছে চীন। এর পরের অবস্থান ভারতের।
বাজার পরিস্থিতি
বাংলাদেশে প্রতি মাসে ৩০ লাখ টন সিমেন্ট উৎপাদিত হয়। দেশের চাহিদা পূরণের পর বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে সিমেন্ট। মাসে ৬০-৭০ হাজার টন সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে। বছরে ৬ থেকে ৭ লাখ টন সিমেন্ট রপ্তানি হয়। বর্তমানে প্রতি বস্তা সিমেন্ট ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়। গড়ে প্রতি টনের দাম ১২ হাজার টাকা। এ হিসাবে দেশে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার সিমেন্টের বাজার রয়েছে।
জনপ্রতি সিমেন্টের ব্যবহার
২০০৯ সালে দেশে জনপ্রতি সিমেন্টের ব্যবহার ছিল মাত্র ৬৫ কেজি। ২০২৩ সালে তা বেড়ে ২১৮ কেজি হয়েছে। ২০২২ সালে ছিল ২২৫ কেজি, ২০২১ সালে ছিল ২২৭ কেজি। তবে এখনো অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। চীনে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার ১ হাজার ৭০০ কেজি। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও দেড় শ কেজির বেশি। শ্রীলঙ্কায় ৫০০ কেজি, মালয়েশিয়ায় ৫২৯ কেজি ও থাইল্যান্ডে এর ব্যবহার ৪২৫ কেজি। সিঙ্গাপুরে মাথাপিছু ১ হাজার ৭০০ কেজি সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি এম ফজলুল হক বলেন, শিল্পোৎপাদনে নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধির কারণে বেশ কিছু সমস্যার সঙ্গে লড়াই করছে এ খাত। একদিকে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এর পাশাপাশি শিল্প খাতের অন্যান্য খরচও বাড়ছে। এ ছাড়া ব্যাপক মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় কেনাকাটাও কমেছে। গত মার্চ থেকে ভোক্তা মূল্যসূচক ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। শিল্প খাতের নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধির কারণে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারছে না।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, শিল্পোৎপাদন কমছে। কারণ, অভ্যন্তরীণ বাজারভিত্তিক ও রপ্তানিভিত্তিক—উভয় কারখানাই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিপুল জ্বালানি ব্যয়ের কারণে শিল্প খাত অনেক চাপে আছে, অন্যদিকে গ্যাস সরবরাহেও ঘাটতি আছে। তিনি বলেন, শিল্প খাতের দুর্বল প্রবৃদ্ধির কারণে অনেক কোম্পানি আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে।
কর্মসংস্থান
পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে এই খাতে প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। উৎপাদন বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং সরকার এ খাত থেকে রাজস্ব আরও বেশি পাবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ডলার ও জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যক্তিগত নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। সরকারি প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকায় সিমেন্ট খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।