বিভিন্ন মহলের সমালোচনা ও সংশ্লিষ্টদের আন্দোলনের মুখে রেস্তোরাঁ সেবার ওপর আরোপিত মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পাশাপাশি তৈরি পোশাক ও মিষ্টি, নন-এসি হোটেল এবং মোটর ওয়ার্কশপ ও গ্যারেজের ওপর আরোপিত ভ্যাট কমানো হয়েছে। এ ছাড়াও ওষুধ ও মোবাইল খাতের ওপর ভ্যাটের চাপ কমানোর বিষয়েও আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।
আজ বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকের পর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অত্যাবশ্যকীয় কিছু কিছু জিনিসের বিষয়ে আমরা বলেছি। তারপর ওষুধ, পোশাকসহ অত্যাবশ্যকীয় যেসব পণ্য সাধারণ লোকজনের ওপর প্রভাব ফেলে, সেগুলো রিভিউ (পর্যালোচনা) করা হচ্ছে।’
এনবিআরের দেওয়া তথ্যমতে, রেস্তোরাঁর ওপর আরোপিত নতুন ভ্যাট প্রত্যাহারের ফলে আগের মতোই ৫ শতাংশ দিতে হবে। তৈরি পোশাক, মিষ্টি, নন-এসি হোটেল এবং মোটর গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপের ওপর বর্ধিত ভ্যাট ৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। হজযাত্রীদের বিমান টিকিটের ওপর আবগারি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এসব বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করে ঘোষণা করা হয়নি।
এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব (মূসক আইন ও বিধি) মো. বদরুজ্জামান মুন্সী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। ঘোষণা হবে রোববারে।’
রেস্তোরাঁর খাবারের বিলের ওপর ভ্যাটের বিষয়ে বদরুজ্জামান মুন্সী বলেন, ‘মূল্য সংযোজন কর ও শুল্ক আইন সংশোধনের মাধ্যমে রেস্তোরাঁ সেবায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছিল। তবে সরকার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে তা আবার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে।’
নিজস্ব ব্র্যান্ডের তৈরি পোশাকের ওপর আরোপিত ভ্যাটও কিছুটা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। ১৫ শতাংশের পরিবর্তে এখন হবে ১০ শতাংশ। তবে সেটাও আগের চেয়ে আড়াই শতাংশ বেশি। কারণ, এর আগে এ খাতে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হতো।
৯ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধি করে। অর্থবছরের মাঝখানে এসে সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলার মতো বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় এই ভ্যাট-শুল্ক আরোপে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। জনসাধারণ, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদেরা অভিন্ন কণ্ঠে এর বিরোধিতা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভ্যাট বৃদ্ধি রাজস্ব বাড়ানোর সহজ কৌশল। যখন মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে নাকাল, তখনই এমন সহজ পথে হেঁটেছে সরকার। ভ্যাটের বোঝা সরাসরি জনগণের ওপর পড়ে। এতে বৈষম্য বাড়ে।’
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি ভ্যাট বাড়ানোর বিরোধিতা করে সংবাদ সম্মেলন, এনবিআরের কাছে লিখিত আবেদন ও মানববন্ধন করেছিল। ব্যবসায়ীরা দাবি করছিলেন ভ্যাটের কারণে লোকজন গত কয়েকদিনে পরিবার নিয়ে রেস্তোরাঁয় খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন।
ভ্যাট প্রত্যাহারের কারণে এনবিআরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রেস্তোরাঁশিল্পকে ক্ষতির মুখ থেকে বাঁচাতে বাড়তি ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেওয়ায় এনবিআরকে ধন্যবাদ জানাই।’
নন-এসি হোটেলের ওপর ভ্যাট হার ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এটি আগে ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। মোটরগাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপের ক্ষেত্রেও ভ্যাট ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
অন্যদিকে গতকাল এক বিশেষ আদেশে তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর সেবার অন্তর্ভুক্ত ই-বুকের স্থানীয় সরবরাহ ও আমদানি পর্যায়ে সমুদয় ভ্যাট অব্যাহতি দিয়েছে এনবিআর। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা ও শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তা বদরুজ্জামান মুন্সী।
আগেই ভাবা উচিত ছিল: বিশেষজ্ঞ
ভ্যাট আরোপ করে চাপের মুখে আবার তুলে নেওয়াকে ভালো চোখে দেখছেন না বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভ্যাট আরোপ করে আবার তুলে দেওয়া হলো। তার মানে পলিসি ভালো নয়। এটা আগেই ভাবা উচিত ছিল। এটা ভবিষ্যতের জন্য একটি খারাপ নজির তৈরি করল।’
তা ছাড়া যেসব পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা সাধারণ মানুষকে খুব বেশি সুবিধা এনে দেবে না বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘এগুলো খুব প্রয়োজনীয় নয়। মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকের ভ্যাট কমানোয় কিছুটা সুবিধা মিলতে পারে। এ ছাড়াও তেমন কোনো সুবিধা হবে না।’