চাহিদা বাড়ায় গত কয়েক মাসে এয়ারলাইনসগুলোর টিকিটের মূল্য বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। বাড়তি এ ব্যয়ের পুরো বোঝা বহন করতে হচ্ছে প্রবাসী কর্মীসহ সাধারণ যাত্রীদের। এ অবস্থায় টিকিটের দাম সহনীয় রাখতে গত ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোকে চিঠি দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। তবে এর তিন দিনের মাথায়ই ১ জানুয়ারি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানভ্রমণের ক্ষেত্রে কর বাড়ানোর প্রস্তাব করে সরকার। এ কারণে ভ্রমণকর বাড়িয়ে কীভাবে টিকিটের দাম সহনীয় রাখা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকার বিরল এক উদ্যোগে অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে কিছু পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আওতায় বিমানের টিকিটের ক্ষেত্রে বিদ্যমান এক্সাইজ ডিউটি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি কার্যকর হলে দেশের ভেতরে-বাইরে সব রুটেই ভ্রমণের ক্ষেত্রে টিকিটের জন্য বাড়তি খরচ বহন করতে হবে। প্রসঙ্গত, বিমানেভ্রমণের ক্ষেত্রে ভ্রমণকর টিকিটের দামের সঙ্গেই যুক্ত হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ রুটের ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রতিটি বিমান টিকিটের ক্ষেত্রে এক্সাইজ ডিউটি ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হচ্ছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করা হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশমুখী ফ্লাইটে এ শুল্ক ৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বিমানযাত্রীদের ব্যয় আরেক দফা বেড়ে যাবে। এনবিআর সূত্র বলছে, ডিউটি বাড়িয়ে বছরে বাড়তি অন্তত ৩০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থা আইএমএফ সম্প্রতি বাংলাদেশকে সহায়তার শর্ত হিসেবে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করতে বলেছে। বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে গত ডিসেম্বরে ঢাকা ঘুরে গেছে আইএমএফের একটি মিশন। এর ধারাবাহিকতায় ১ জানুয়ারি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর অধ্যাদেশের খসড়াও নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাইয়ের পর গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে এ-সংক্রান্ত দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।
এর আগে এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান আজকের পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘দেশ চালাতে রাজস্ব লাগবে। সে জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।’
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এয়ারলাইনসগুলোর পরিচালন ব্যয় বেশি। দেশি এয়ারলাইনসগুলোকে প্রতিযোগী বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর চেয়ে বেশি দামে জ্বালানি কিনতে হয়। বিদ্যমান ভ্যাট, ট্যাক্স ছাড়াও বিমানবন্দর ব্যবহারের বিভিন্ন ধরনের চার্জ প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বেশি। এর প্রভাবে সাধারণত টিকিটের মূল্য বেশি হয়। এ অবস্থায় আরেক দফা এক্সাইজ ডিউটি বাড়ানো হলে বিমানের টিকিটের দাম আরও বাড়বে। এটি লাখো প্রবাসীসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশগামী সাধারণ যাত্রীদের ওপর আর্থিক চাপ বাড়াবে। এর প্রভাবে দেশের এভিয়েশন খাতের টেকসই উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে।
দেশি এয়ারলাইনস এয়ার অ্যাস্ট্রার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান আসিফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে বিমান টিকিটের ক্ষেত্রে এক্সাইজ ডিউটি বৃদ্ধি যাত্রী ও শিল্প খাত উভয়ের জন্য বড় চাপ। কর বৃদ্ধির ফলে দেশি এয়ারলাইনসগুলোর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস পাবে। বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো আরও সুবিধা পাবে। কারণ, প্রতিযোগিতায় থাকতে তারা হয়তো বাড়তি করের অংশটুকু অন্যভাবে পূরণ করে টিকিটের দাম কম বাড়াবে। এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যায় পড়বে দেশীয় এয়ারলাইনসগুলো।’
ইমরান আসিফ বলেন, বাংলাদেশের আকাশপথের পরিবহন খাতের বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে প্রবাসী কর্মীদের ভ্রমণ। বিদেশগামী কর্মীরা সাধারণত নিজেরা এয়ারলাইনস পছন্দ করার সুযোগ পান না। জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্টরা তাঁদের পক্ষে কাজটি করে থাকেন। এজেন্টরা যেখানে দাম অল্প কিছু হলেও কম পাবেন, সেখান থেকেই টিকিট কাটবেন। ফলে কর বৃদ্ধির আর্থিক চাপ সরাসরি বাংলাদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ওপর পড়বে। কর বৃদ্ধির ফলে সরকারের রাজস্ব আদায় সাময়িকভাবে বাড়লেও দীর্ঘ মেয়াদে স্থানীয় এয়ারলাইনস শিল্প গভীর সংকটে পড়তে পারে। বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা তাদের জন্য আরও কঠিন হবে।
উল্লেখ্য, টিকিটের দাম সহনীয় রাখতে গত ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী এয়ারলাইনসগুলোকে চিঠি দেয় বেবিচক। বেবিচকের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি রেগুলেশন্স ও ইন্সপেকশন অথরাইজেশন) গ্রুপ ক্যাপ্টেন আহসান হাবীব স্বাক্ষরিত চিঠিটি বিদেশি ২৪টি এয়ারলাইনসকে পাঠানো হয়। চিঠিতে যাত্রীদের যাতায়াত বৃদ্ধি পাওয়ার সময়ে বিমানভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতার কথা উল্লেখ করা হয়। এতে এয়ারলাইনসগুলোর পরিচালন এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের বিষয়টি স্বীকার করেও বলা হয়, এভিয়েশন শিল্পের সমৃদ্ধির স্বার্থে এবং যাত্রীদের বিমানভ্রমণে আরও উৎসাহিত করতে টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বিবেচনা করা জরুরি। চিঠিতে এয়ারলাইনসগুলোকে ভাড়ার হার পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানানো হয়।
বেবিচকের ওই চিঠির কিছুদিন আগে (১২ ডিসেম্বর) উড়োজাহাজভাড়া সহনীয় রাখার অনুরোধ জানিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। এর পরিপ্রেক্ষিতেই এয়ারলাইনসগুলোকে নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বেবিচককে চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে আটাবের সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর যাত্রী কমে যাওয়ায় বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়েছিল, এখন পর্যন্ত তা আর বাড়ায়নি। এতে করে ফ্লাইটের সংখ্যা কমে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হওয়ায় টিকিটের দাম বেড়েছে। যে হারে বেড়েছে, তা অসহনীয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হারে। কয়েক মাস আগেও যে টিকিটের দাম ছিল ৪০ হাজার, তা বর্তমানে ৭০ হাজার টাকার বেশি। এ অবস্থায় এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ানো উচিত।’