দেশের খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কৃষি উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি খাতে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং প্রতিবছর নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। পাশাপাশি কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদান এবং কৃষিজমির সুরক্ষার জন্য সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ব্যাংকগুলোর শর্তারোপ, অনীহা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষার কারণে কৃষিঋণ বিতরণ কমেছে। এর ফলে কৃষকদের একটি অংশ চাষাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, যা খাদ্য উৎপাদন ও বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি খাতে ৩৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) মাত্র ১৩ হাজার ৮১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, যা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৩৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় কৃষিঋণ বিতরণ কমেছে ২ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা; যা শতাংশের হিসাবে ১৪ দশমিক ৩৯।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কৃষিঋণ বিভাগের প্রধান বলেন, জুলাইয়ের পর সার্বিক ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে এসেছিল। ১০-১২টি ব্যাংক কিছুটা সমস্যায় পড়েছিল। তারা তখন ঋণ দিতে পারেনি। তাই সার্বিক কৃষিঋণ বিতরণে এটা প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু কৃষিঋণের টার্গেট দেওয়া থাকায় এটা আমাদের দিতেই হবে। আগামীতে আশা করছি ঋণ বিতরণ বাড়বে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ২ লাখ ২৫ হাজার ৫৫১ হেক্টর। চাষাবাদের আওতায় এসেছে ৫৫ হাজার ৫৬ হেক্টর জমি। আবাদযোগ্য পতিত জমির মধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমি এখনো পড়ে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, কৃষি উৎপাদন এবং খাদ্যনিরাপত্তা বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিবছর কৃষিঋণ নীতিমালা ঘোষণা করে। সেখানে কৃষকদের জন্য একটা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। ব্যাংকগুলোকে কৃষিঋণ বিতরণে বাধ্য করার নানা বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু তারা বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে কৃষিঋণ বিতরণে অনীহা দেখায়। এমনকি কৃষকের ঋণ বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেয়। মূলত ছোট গ্রাহককে ঋণ বিতরণ, মনিটরিং এবং আদায়ে ঝামেলা মনে করায় অনেক ব্যাংক ঋণ দিতে অনীহা প্রকাশ করে। এতে কৃষক ঋণ পান না। আর ঋণ না পাওয়ায় কৃষিকাজ ছেড়ে দিচ্ছে কৃষক। এতে উৎপাদন কমে যাচ্ছে; যা পণ্যের জোগানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এতে উসকে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, কৃষিঋণ বিতরণের স্থিতি ৫৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে ১৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা। বকেয়া রয়েছে ২৯ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা এবং মেয়াদোত্তীর্ণ বকেয়ার (খেলাপি নয়) পরিমাণ ১১ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। আর মোট ঋণের মধ্যে ৫ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে; যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইনস্টিটিউট অব অ্যাগ্রিবিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সাবেক পরিচালক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, কৃষিতে ঝুঁকি বেশি এবং উৎপাদন খরচ বাড়লেও কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ভর্তুকি ও সহজ শর্তে সরাসরি ঋণ দেওয়া হলে কৃষকের খরচ কমবে এবং মুনাফা বাড়বে। আগের সরকারের সময় করপোরেটের মালিকরা কৃষিঋণ বেশি পেয়েছে। এতে প্রকৃত কৃষক ঋণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ব্যাংকগুলো নিজস্ব নেটওয়ার্ক (শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং, দলবদ্ধ ঋণ বিতরণ) এবং ব্যাংক-এমএফআই লিংকেজ ব্যবহার করতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫০ শতাংশের কম হতে পারবে না। আর মোট লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ শস্য ও ফসল খাতে, ১৩ শতাংশ মৎস্য খাতে এবং ১৫ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতে ঋণ বিতরণ করতে নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া কৃষি খাতেই বিনিয়োগের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কমন ফান্ড (বিবিএডিসিএফ)’ নামে একটি ফান্ড গঠন করেছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোর অনর্জিত অংশ এ ফান্ডে জমা করতে হবে। এই জমা করা অর্থের বিপরীতে তাদের ২ শতাংশ হারে সুদ দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সঞ্চিয়া বিনতে আলী বলেন, কৃষিঋণ বিতরণে সব ধরনের চেষ্টা করছে ব্যাংকটি। কৃষিঋণ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন মেনে চলে কৃষি ব্যাংক। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিবছর লক্ষ্য পূরণ করে। চলতি বছরেও লক্ষ্য পূরণ হবে।