Ajker Patrika
হোম > অপরাধ > আষাঢ়ে-নয়

ভয়ংকর গল্প সমঝোতায় শেষ

কামরুল হাসান

ভয়ংকর গল্প সমঝোতায় শেষ

সকাল থেকেই চারদিকে চাউর হচ্ছিল খবরটি। কিন্তু কিনারা করা যাচ্ছিল না কিছুতেই। কোনো ঘটনার সঙ্গে যখন প্রভাবশালী কেউ জড়িত থাকেন, তখন প্রায় এ রকমই হয়। সহজে কেউ মুখ খোলেন না, পাছে কোনো বিপদ হয়। ‘মুখ খোলা’ কথাটার মধ্যে একটু স্বীকারোক্তির গন্ধ আছে, বিষয়টি সে রকম নয়। আমি বলছি তথ্য দিয়ে সহায়তা না করার কথা। কিন্তু ওই যে কথায় আছে, ধোঁয়া, টাকা আর খবর গোপন থাকে না। তা-ই হলো। দুপুরের মধ্যে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। 

এটা ছিল ২০০১ সালের ১০ মার্চ, শনিবারের সকাল। রোজকার মতো বেলা ১১টায় রিপোর্টার্স মিটিংয়ে ঢোকার আগেই শুনি, ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে গন্ডগোল হয়েছে। যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনাকেই আমরা ‘গন্ডগোল’ বলি, সেটা নাকি তার চেয়েও বড় ঘটনা। সঙ্গে সঙ্গে চেনা কয়েকজন কর্মকর্তাকে ফোন দিলাম, কিন্তু তাঁরা কিছু বলতে পারলেন না। গোয়েন্দা সংস্থার পরিচিত একজনকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন, ঘটনা একটা ঘটেছে, তবে সেটা সেনানিবাসের কিছু না। আরেকজন বললেন, গুলশানের ঘটনা, সেটা সেনানিবাস পর্যন্ত গড়িয়েছিল, তবে দুপক্ষই সিভিলিয়ান (বেসামরিক)। এভাবে একটার পর একটা তথ্য দানা বাঁধছে। শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, সেটা জানতে দুপুর গড়িয়ে গেল।

বিকেলের দিকে প্রথমে গেলাম ক্যান্টনমেন্ট থানায়। আনোয়ার হোসেন নামের এক পরিদর্শক ছিলেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি বেশ সহায়তা করলেন। বললেন, ঘটনার অর্ধেক গুলশানে আর অর্ধেক ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায়। তিনি যেটুকু বললেন, তা দিয়ে কোনো নিউজ হয় না। এলাম গুলশান থানায়। গুলশানের ওসি আমার পূর্বপরিচিত, তিনি সামনে রাখা জিডির বইটি পড়তে দিলেন। দেখি পুলিশের করা জিডিতে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ।

২০০১ সালের ৯ মার্চ ছিল শুক্রবার। এদিন রাত ১২টার দিকে একটি পাজেরো ব্র্যান্ডের এসইউভি গুলশান থেকে বারিধারার দিকে যাচ্ছিল। গাড়িতে ছিলেন পলমল গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল হক সিকদারের স্ত্রী ও তাঁর দুই কন্যা। সিকদারের দুই শিশুনাতিও ছিল গাড়িতে। গাড়িটি গুলশানের ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্ক (বর্তমানে শিশুপার্ক) অতিক্রম করার সময় উল্টো পথ দিয়ে নীল রঙের একটি প্রাইভেট কার এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। কারটিতে এক প্রভাবশালীর পুত্র ও তাঁর দুই বন্ধু বসে। প্রভাবশালীর পুত্রের গাড়িটি পাজেরোর মুখোমুখি হতেই শুরু করে গুলিবর্ষণ। সেই গুলি প্রথমে পাজেরোর সামনের কাচে, এরপর চাকায় লাগে। পরপর সাতটি গুলিতে প্রকম্পিত হয় চারপাশ। গুলিবর্ষণের ফলে গাড়ির সামনের কাচ পুরো ভেঙে যায়। পাজেরোর চালক সামান্য আহত হয়েও দ্রুতগতিতে গাড়িটি পেছনে নিয়ে মহাখালীর দিকে যেতে থাকেন। এবার প্রভাবশালীর ছেলের গাড়িটিও সেই গাড়িকে পিছু ধাওয়া করে। গভীর রাতে ঢাকার রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে ছুটতে থাকে দুটি গাড়ি। একপর্যায়ে সিকদারের গাড়িটি ডিওএইচএসের রাস্তা দিয়ে সোজা ঢুকে পড়ে সেনানিবাসের ভেতরে। তখন পেছনের প্রভাবশালীর গাড়িটি সেনানিবাসের গেটে আসে, কিন্তু কী মনে করে থেমে যায়।

গভীর রাতে অনুমতি ছাড়া ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে পাজেরো ঢুকতে দেখে মিলিটারি পুলিশের সদস্যরা সতর্ক হয়ে ওঠেন। তাঁরা গাড়িটির পিছু ধাওয়া করেন। পাজেরোর চালক দেখতে পান, তাঁদের গাড়ির পেছনে সাইরেন বাজিয়ে মিলিটারি পুলিশের একটি গাড়ি আসছে। এরপর পাজেরোটি সোজা চলে যায় সেনাপ্রধানের অফিসের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে নুরুল হক সিকদারের স্ত্রী-কন্যারা আশ্রয় নেন সেনাপ্রধানের অভ্যর্থনাকক্ষে। রাতে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এ নিয়ে তুমুল হইচই পড়ে যায়। ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা ঘটনা শুনে ছুটে আসেন। তাঁরা সবার কাছে পুরো ঘটনা শোনেন। লে. জেনারেল এম হারুন-অর-রশিদ তখন সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। বিষয়টি সেনাপ্রধানের কানেও যায়।

প্রভাবশালীর গাড়িটি প্রথম দফায় এমপি চেকপোস্ট থেকে ফিরে গেলেও কিছুক্ষণ পর আবার আসে। এবার তারা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ঢোকার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে মিলিটারি পুলিশের বাধা না মেনে সেনানিবাসের ভেতরে ঢুকে পড়ে গাড়িটি। মিলিটারি পুলিশ গাড়ি ও আরোহীদের আটক করে। খবর দেওয়া হয় গুলশান থানা-পুলিশকে। পুলিশ এসে সেই প্রভাবশালীর পুত্রকে থানায় নিয়ে যায়। শনিবার সকাল আটটা পর্যন্ত তাঁদের তিনজনকে থানাতেই রাখা হয়। সিকদারের পরিবারের সদস্যদেরও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

প্রিয় পাঠক, এটুকু শুনে আপনার মনে হতেই পারে, এরপর আইন মেনে মামলা হবে এবং সেই সব আসামিকে জেলে পাঠানো হবে। আর টেলিভিশনের ক্যামেরাগুলো সেই খবর সংগ্রহে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। শুরু হয় দেনদরবার। পর্দার অন্তরালে চলতে থাকে আলোচনা। সকাল ১০টার আগেই সবকিছু ম্যানেজ হয়ে যায়। এরপর বীরদর্পে বন্ধুসমেত থানা থেকে বেরিয়ে যান সেই প্রভাবশালীর পুত্র।

আমি থানায় গিয়ে পুরো ঘটনা শুনি। এরপর ওসির কাছ থেকে নম্বর নিয়ে সেখানে বসেই প্রথমে ফোন দিলাম নুরুল হক সিকদারের স্ত্রীকে। তিনি ফোনে আমাকে বললেন, ‘এটা নিয়ে কোনো কথা বলব না, আমি তো অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছি।’ এবার ফোন দিলাম সেই প্রভাবশালীর পুত্রকে। তিনি পরিষ্কার গলায় বললেন, ‘এটা ভাই ভুল-বোঝাবুঝি ছিল। সব মীমাংসা হয়ে গেছে।’

আমি ওসির দিকে তাকালাম। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, এ নিয়ে কোনো মামলা হবে না? ওসি হেসে বললেন, সবই তো বোঝেন। পরদিন ১১ মার্চ এ নিয়ে ঢাউস আকারে একটি নিউজ ছাপা হলো।

পাঠক, এবার বলি, কে সেই প্রভাবশালী। তিনি জনাব সাদিক আবদুল্লাহ। আর কিছু বলতে হবে?

আরও পড়ুন:

মরণের দূত, ভালোবাসার কান্না

এখনো কাঁদেন রোকেয়া প্রাচী

অধরা জিসানের উপাখ্যান

অর্থ যখন অনর্থের মূল

যে চোখের পানির নাম ‘রেমিট্যান্স’

সাধারণ এক নারীর জীবনবোধ

এক অসহায় পিতার আত্মসমর্পণ

সাধু বেশে পাকা চোর অতিশয়

জটিল সমস্যার সরল সমাধান

জেলে জেমস, প্রেমে পাগল মেয়েটি