Ajker Patrika

মরণের দূত, ভালোবাসার কান্না

কামরুল হাসান
আপডেট : ১৫ জুলাই ২০২৩, ০৮: ৫১
Thumbnail image

সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে ইস্কাটনে জনকণ্ঠ ভবনে পৌঁছাতে বড়জোর ১৫ মিনিট লাগার কথা। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে টেলিফোন অপারেটর লিজার দুবার ফোন। এক যুবকের তাড়ায় লিজার তর সইছিল না। সেই যুবক আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য সকাল থেকে অপেক্ষায় আছেন।

অফিসে ঢুকতেই দেখি, অভ্যর্থনা-কক্ষের সোফায় আধশোয়া এক সুদর্শন যুবক। পোশাক-আশাক ততটা পরিপাটি নয়, কিছুটা অগোছালো। নির্ঘুম ঢুলুঢুলু লাল চোখ। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আমার নাম রিপন, আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।’ আমি হাত বাড়িয়ে বললাম, ধন্যবাদ। এরপর যুবকটি যা বললেন, তা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। এ রকম পরিস্থিতির জন্য কারও প্রস্তুত থাকার কথাও নয়। রিপন শান্তভাবে বললেন, ‘আমি আমার স্ত্রীকে খুন করে এসেছি।’

আমি তো থ! কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। মুখের ভাষা যেন হারিয়ে গেছে। একবার ভাবছিলাম, যুবকটি ঠিক বলছেন তো! আবার মনে হচ্ছিল, শুধু শুধু মশকরা করার জন্য কেউ সাতসকালে পত্রিকা অফিসেই-বা আসবেন কেন। রিপন আর কিছুই বললেন না। আমার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে ছিলেন উত্তরের অপেক্ষায়।

রিপনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এর দুই মাস আগে টাইম ম্যাগাজিনে পড়া একটি কভারস্টোরির কথা মনে পড়ে গেল। জনকণ্ঠের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী আলী হাবিব এটা পড়তে দিয়েছিলেন। ‘জোডিয়াক কিলার’ নামের এক খুনিকে নিয়ে লেখা। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় এই ব্যক্তি ৩৭ জনকে খুন করেছিলেন। প্রতিটি খুনের পর পুলিশ ও সংবাদপত্র অফিসে খুনের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে চিঠি পাঠাতেন, কিন্তু কেউ তাঁকে ধরতে পারেনি। জোডিয়াক কিলারের সঙ্গে তো এই যুবকের কোনো মিল নেই! তবে কেন নিজেই এসে ধরা দিতে চাইছেন? আমার ঘোর কাটছিল না কিছুতেই।

জনকণ্ঠ ভবনের যে তলায় রিপোর্টিং বিভাগ, সেখানে অতিথিদের বসার জন্য দুটি ছোট রুম ছিল। তার একটিতে যুবককে নিয়ে বসিয়ে জানতে চাইলাম, কিছু খাবেন? তিনি না সূচক মাথা নাড়লেন। আবার বললাম, নাশতা-টাশতা হয়েছে? তিনি জানালেন, না, কিছুই খাননি। অফিসের পিয়ন মেহেদী নাশতা আনতে গেল।

দেখেশুনে মনে হচ্ছিল, যুবকটি খুবই উদ্বিগ্ন। বারবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলেন। এই অবস্থায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা কতটা নিরাপদ ভাবতে ভাবতে মনে হলো, যুবকটি নাশতা খেয়ে নিলে তারপর কথা বলা যাবে। নাশতা এল। মনে হলো, তিনি খুবই ক্ষুধার্ত ছিলেন। খেয়ে বেশ তৃপ্ত হলেন। পানি খেলেন দুই গ্লাস। এবার তাঁর সামনে বসে জানতে চাইলাম কী ঘটেছিল।

এতক্ষণ আমার কর্মকাণ্ড দেখে যুবকের সন্দেহ, আমি তাঁর কথা বিশ্বাস করিনি। তিনি আবারও বললেন, ‘আমি সত্যি সত্যিই স্ত্রীকে খুন করে এসেছি।’ আমি মাথা নেড়ে তাঁর কথায় সম্মতি দিয়ে জানতে চাইলাম, লাশ কোথায়? তিনি বললেন, ‘খিলক্ষেতের বাসায়। তালা দিয়ে এসেছি।’ বললাম, কেন খুন করলেন?

ধীরে ধীরে নিজেকে খুলে দিলেন রিপন। বললেন, তাঁর স্ত্রীর নাম সালমা আক্তার। দুজনেরই বাড়ি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে। প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। দুজনেই স্নাতক অব্দি পড়েছেন। কিন্তু তাঁদের বিয়ে পরিবারের কেউ মেনে নেননি। এরপর জীবনের লড়াই চালাতে ঢাকায় চলে আসেন। অল্প বেতনে স্বামী-স্ত্রী কাজ নেন ছোট একটি এনজিওতে। সবকিছু ভালোই চলছিল। একদিন হঠাৎ রিপনের মনে হলো, স্ত্রী সালমা তাঁর বসের প্রতি অনুরক্ত। তাঁর কথায় ওঠাবসা করেন। বসের সঙ্গে বিভিন্ন জেলা সফরে যাওয়ার পর সন্দেহটা গভীর হলো। রিপন মনে করছিলেন, স্ত্রীর সব ভাবনা এখন বসকে নিয়ে। তাঁর দিকে স্ত্রীর কোনো মনোযোগ নেই। এসব নিয়ে প্রথম দিকে কিছু ঝগড়া হলো, কিন্তু কাজ হলো না। সবকিছু অস্বীকার করে উল্টো রিপনকে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিলেন সালমা।

আমি বললাম, সবই তো সন্দেহ থেকে বললেন, কোনো কিছুর প্রমাণ নেই? রিপন বললেন, ‘ওই যে কথায় আছে, কৌশল, জোরজবরদস্তি আর ভালোবাসায় পৃথিবীর সব তালা খোলা যায়। কাল রাতে এ নিয়ে অনেক কথা-কাটাকাটি হলো। সালমার মনের তালাও খুলে গেল। একপর্যায়ে সবই স্বীকার করল। এরপর সে ঘুমিয়ে পড়তেই আমার মাথায় খুন চেপে গেল। ঘুমের মধ্যে তার মুখে বালিশ চাপা দিলাম।’ আমি বললাম, বাধা দেয়নি? যুবক বললেন, ‘চরকার মাকুর মতো দুই হাত ছুড়ে বাঁচার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমার শক্তির কাছে পারেনি।’

বিস্মিত হয়ে বললাম, তারপর? রিপন বললেন, ‘বালিশ সরিয়ে একবার নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখলাম, নিশ্বাস পড়ছে কি না। এরপর সারা রাত সেই মৃতদেহের পাশে শুয়ে ছিলাম। সকাল হওয়ার পর ঘরে তালা দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়ি। কোথায় যাব স্থির করতে পারছিলাম না। পরে সিদ্ধান্ত নিই, পত্রিকা অফিসে গিয়ে ক্রাইম রিপোর্টারের কাছে সব বলে সাহায্য চাইব।’ খিলক্ষেত থেকে তিনি হাঁটতে হাঁটতে ইস্কাটনে এসেছেন। এটুকু বলে আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘এই অবস্থায় আমার কী করা উচিত?’

আমি তাঁকে বললাম, আপনি চাইলে এখান থেকে চলে যেতে পারেন। তবে আমার পরামর্শ হলো পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার। সেটাই ভালো হবে। রিপন বললেন, ‘দুটি কারণে আমার ভয়। একটি হলো, পুলিশের কাছে গেলেই তারা আমাকে মারধর করবে; অন্যটি হলো, তারা আমার দরিদ্র পরিবারকে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত করবে।’

আমি বললাম, আপনি চাইলে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি। তার আগে আপনি আরও কিছুক্ষণ ভাবতে পারেন। রিপন কোনো সময় না নিয়ে বললেন, ‘আমি সালমাকে অনেক ভালোবাসি বলেই খুন করেছি। এখন আর পালিয়ে যাব না। আপনি ব্যবস্থা করুন।’

রমনা থানার ওসি ছিলেন রফিকুল ইসলাম। তাঁকে ফোন করতেই কয়েকজন পুলিশসহ তিনি এসে হাজির হলেন। যুবকের কথা শুনে ওসিও বেশ অবাক। আমি যুবকের দুটি শর্তের কথা ওসিকে বলতেই তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। যুবককে নিয়ে ওসি থানায় গেলেন।

ঘণ্টা দুয়েক পরে ওসি রফিকুল ইসলামের ফোন। বললেন, সেই যুবককে নিয়ে যাবেন তাঁর বাসায়। আমি চাইলে তাঁর সঙ্গে যেতে পারি। পুলিশের দলের সঙ্গে আমিও গেলাম রিপনের বাসায়। রিপন যেভাবে বর্ণনা করেছিলেন, সবকিছুই মিলে গেল। লাশ উদ্ধার করে হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হলো, আর রিপনকে গ্রেপ্তার করে রাখা হলো হাজতে। পরদিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন রিপন।

বছর দুয়েক পরে বিপ্লব নামের এক ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। সে নিজেকে সালমার ভাই পরিচয় দিয়ে বলল, খিলক্ষেত থানার সেই খুনের মামলার প্রধান সাক্ষী আমি। তাঁর বোনের খুনের মামলা আটকে আছে আমি সাক্ষ্য না দেওয়ায়। ছেলেটি আমাকে আদালতে যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করল। আমি তাকে সাফ জানিয়ে দিলাম, আমি সাক্ষ্য দেব না, এটা আমার কাজ নয়। এর কিছুদিন পর এল সাক্ষী পরোয়ানা। রমনা থানার এক দারোগা একদিন এসে বললেন, ‘সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালত আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে আদেশ দিয়েছেন।’ নানা কায়দা করে সেটাও এড়ালাম। কিছুদিন পর ফোন করলেন সেই মামলার পিপি। তিনি খুব অনুরোধ করে বললেন, ‘এই মামলার আপনিই একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সাক্ষ্য না দিলে আসামি বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত পিপির অনুরোধে সাক্ষ্য দিলাম।

আরও বছরখানেক পর মামলার রায় হলো। ১২ বছরের সাজা হলো রিপনের। এর মধ্যে আমার কর্মস্থল বদল হলো। একদিন কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনের দোতলায় অফিসে কাজ করছি। অভ্যর্থনা থেকে কে যেন জানালেন, একজন লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। গিয়ে দেখি সেই রিপন। খুনের মামলায় সাজা খেটে বেরিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। হঠাৎ তাঁকে দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো, সে আমার কোনো ক্ষতি করতে এসেছে। সব মিলিয়ে এক অজানা শঙ্কা গ্রাস করল। আমি এমন ভাব করলাম যেন তাঁকে চিনতেই পারিনি। দু-একটি কথা বলে নিরাশ হয়ে চলে গেলেন রিপন।

অফিসের ভেতরে গিয়ে সিটে বসেছি, কিন্তু মন খুবই অস্থির। কিছুতেই কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না। একটু পরে দোতলার সিঁড়ির কাছে এলাম। জানালা দিয়ে দেখি, রাস্তার ওপারে সিএ ভবনের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রিপন। কিছুক্ষণ দেখার পর রিপনের প্রতি খুব মায়া হলো। কী যেন মনে করে রাস্তায় গিয়ে গলা চড়িয়ে ডাকলাম, রি...প...ন...। মনে হলো, তিনি অপেক্ষায়ই ছিলেন। আমার ডাক শুনে প্রাণপণে দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে এপারে এলেন। এরপর আমাকে ধরে কাঁদতে লাগলেন শিশুর মতো। জড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ, অনেকক্ষণ, অনন্তকাল...। তাঁকে কোনোমতে থামিয়ে জানতে চাইলাম, কিছু খাবেন? রিপন বললেন, ‘না স্যার, আজ যাই। অনেক দূর যেতে হবে। নতুন করে বাঁচব বলে আপনার দোয়া নিতে এসেছি।’ আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফার্মগেটের দিকে হেঁটে চলে গেলেন রিপন।

আমি তাঁর পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হালকা উত্তুরে হাওয়া গায়ে লাগছিল। মনে হচ্ছিল, বুকের পাথরটা ধীরে ধীরে সরে গেল।

আষাঢ়ে নয় সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নারী সহকর্মীর সঙ্গে রাতযাপন: হাইটেক পার্কের ডিডি আতিক বরখাস্ত

বাংলাদেশসহ ৩ দেশে উন্নয়ন সহায়তা বন্ধের সিদ্ধান্ত সুইজারল্যান্ডের

বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের পদত্যাগ

পদ্মা সেতু ও ড. ইউনূসকে নিয়ে ভারত থেকে শেখ হাসিনার ভাষণ! ভাইরাল ভিডিওর পেছনের ঘটনা জানুন

২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন কর্মসূচি শুরু

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত