রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নির্যাতনের শিকার কল্পনা (১৩) সাড়ে তিন মাস চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে। আজ বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা মেডিকেল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট থেকে তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
আজ বেলা সাড়ে ৩টার দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে কল্পনাকে বিদায় জানান। এ সময় কল্পনাকে ২৫ হাজার টাকার একটি চেক তুলে দেন তিনি।
আগামী রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) আদালতের মাধ্যমে কল্পনাকে মা-বাবার জিম্মায় দেওয়া হবে। সরকারি ছুটির কারণে আদালত বন্ধ থাকায় আজ মা-বাবার সঙ্গেই হাসপাতালে অবস্থান করছে কল্পনা।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার মো. আসাদুজ্জামান, বার্ন ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. বিধান সরকার, হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মো. আশরাফুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক ডা. মো. আব্দুর রহমান, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সমন্বয়ক ডা. সাবিনা ইয়াসমিনসহ চিকিৎসক ও কর্মচারীবৃন্দ।
উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ বলেন, ‘শিশু নির্যাতন নিয়ে সবাইকে শক্তভাবে কাজ করতে হবে। নির্যাতনের হার কমাতে দ্রুত অ্যাকশনে যেতে হবে। কল্পনার চিকিৎসা ও আইনি সহায়তার পাশাপাশি তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে। শিশু গৃহকর্মী কল্পনাকে নির্যাতনের কারণে তার শারীরিক অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। চিকিৎসকেরা তাকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে। তাদের আইনি সহযোগিতাসহ যেকোনো সহযোগিতার জন্য আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। এখন সে পুরাপুরি সুস্থ। কল্পনা পড়াশোনা করতে চাইলে তাকে সার্বিক সহায়তা করা হবে।’
কল্পনার মা-বাবার উদ্দেশে এই উপদেষ্টা বলেন, যদি আসামি পক্ষ কোনো প্রকার লোভ দেখায় অথবা মীমাংসার কথা বলে, আর যদি মীমাংসা করা হয় তাহলে সব প্রকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে।
বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘মেয়েটিকে আমরা ভয়ংকর হিসেবে পেয়েছিলাম। মেয়েটা রক্তশূন্যতায় ছিল, দাঁত ছিল না। শরীরের এমন কোনো জায়গা ছিল না যেখানে ক্ষত নেই। চোখে-মুখে ছিল ভয়ভীতি। কল্পনার শরীরের বিভিন্ন জখমে পুঁজ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম অপারেশনে কেবল আধা কেজির মতো পুঁজই বের করেছি আমরা। ওর শরীর কোনোও ধরনের সার্জারির জন্য ফিট ছিল না। পুঁজ বের করার পর খাওয়াদাওয়া করানো হয় ঠিক করে।’
নাসির উদ্দিন বলেন, সবচেয়ে বেশি ছিল মানসিক ভীতি, মানসিকভাবে সে ছিল বিধ্বস্ত। সে জন্য কাউন্সেলিং করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। চিকিৎসার বিষয়ে ওর মনের ভেতরে যেন কোনো সংশয় বা আক্ষেপ না থাকে সে জন্য তাকে ছয় মাস পর আবার আসতে বলা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী রোববার আদালতের মাধ্যমে কল্পনাকে পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হবে।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় দিনাত জাহান আদর নামে এক নারীর বাড়িতে কল্পনা গৃহকর্মীর কাজ করত। সেখানে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় সে। নির্যাতনের বর্ণনায় কল্পনা বলেছিল, হেয়ার স্ট্রেইনার মেশিন দিয়ে কাজ না পারা বা ভুল করার অজুহাতে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো, পেটানো হতো লাঠি দিয়ে। এমনকি আদরের ভাই তাকে ধর্ষণ করতে চাইত বলেও অভিযোগ করে সে।
কল্পনার বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলায়। তার বাবার নাম শহিদ মিয়া ও মা আফিয়া বেগম। পাঁচ বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সে পঞ্চম।
আফিয়া বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ৫ বছর ধরে মাসে ৫ হাজার টাকা বেতনে ওই বাসায় কাজ করছিল তাঁর মেয়ে। পরে ১০ হাজার বেতন দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব টাকা তাঁরা পেতেন না। এমনকি তাঁদের সঙ্গে কথাও বলতে দেওয়া হতো না। ফোন করলেই দিনাত বলত, মেয়ে ভালো আছে। তবে যখন কথা হতো, তখন দিনাত সামনে থাকত। যার কারণে নির্যাতনের কথা বলতে পারত না।
নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর মেয়েকে মারধরের অভিযোগে মা আফিয়া বেগম বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ভাটারা থানায় দিনাত জাহানের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার পরপরই দিনাত এবং তাঁর ভাইকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দুজনই এখন কারাগারে আছেন।