পেশায় তিনি ছিলেন একজন চুক্তিভিত্তিক কম্পিউটার অপারেটর। দৈনিক বেতন ১৩০ টাকা। এখন তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৪৬০ কোটি টাকা। আছে ঢাকায় ৬টি বাড়ি, ১৩টি প্লট, সাভারে ৭টি জমি, ৪টি রিকশার গ্যারেজ, টেকনাফে বাগানবাড়ি, সেন্ট মার্টিনে প্লট, ব্যাংকে ১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আরও আছে সাভারে তিন একর জমির ওপর নির্মাণাধীন পার্ক আর ক্রয় প্রক্রিয়ায় থাকা একটি জাহাজ।
এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ যাঁর, তাঁর নাম নুরুল ইসলাম। তবে সম্পদের মালিক হন টেকনাফ স্থলবন্দরে দালালি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, চোরাকারবারি, শুল্ক ফাঁকি আর অবৈধ পণ্য খালাস করে। সঙ্গে ইয়াবার মতো মাদক ব্যবসা তো আছেই। রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে মঙ্গলবার রাতে র্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে।
গ্রেপ্তারের সময় তাঁর কাছে থেকে পাওয়া গেছে ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টাকার জাল নোট, মিয়ানমারের ৩ লাখ ৮০ হাজার মুদ্রা, ৪ হাজার ৪০০টি ইয়াবা এবং ২ লাখ ১ হাজার ১৬০ টাকা।
নুরুল ইসলামকে নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেন বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, ২০০১ সালে টেকনাফ স্থলবন্দরে কম্পিউটার অপারেটর ছিলেন নুরুল ইসলাম। একপর্যায়ে বন্দরে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ধীরে ধীরে জাহাজ থেকে বিভিন্ন পণ্য খালাসের কর্তৃত্ব করাসহ ভেতরে-বাইরে দালালি করতে শুরু করেন। এসব করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ২০০৯ সালে সেই চাকরি ছেড়ে ১০-১৫ জন আস্থাভাজনকে নিয়ে নতুন সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে আনা কাঠ, শুঁটকি, আচার, মাছসহ অন্য বৈধ পণ্যের আড়ালে অবৈধ পণ্য আনা-নেওয়া করতে থাকেন। এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হন তিনি। বর্তমানে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৪৬০ কোটি টাকা।
র্যাব জানায়, তাদের অনুসন্ধানে নুরুল ইসলামের যে সম্পদ পাওয়া গেছে, তা কম নয়। তাঁর আছে ঢাকায় ৬টি বাড়ি, যার মূল্য ৭৩ কোটি টাকা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আছে ১৩টি প্লট, ৪টি রিকশার গ্যারেজ, যার মূল্য ৩১ কোটি টাকা। সাভারে আছে ৭টি জমি, যার মূল্য ১১৮ কোটি টাকা। টেকনাফে আছে জমিসহ বাগানবাড়ি, সেন্ট মার্টিনে নুরুলের যে জমি রয়েছে তার দাম ১২ কোটি টাকা। নুরুলের স্ত্রীর রয়েছে একটি গাড়ি। আর নুরুলের ব্যাংকে জমা আছে ১ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি করার সময় বড় বড় ব্যবসায়ী, বন্দরে যাঁরা কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, তাঁদের সঙ্গে তিনি সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তিনি এসব সম্পদ করেন। কীভাবে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া যায়, সেসব কৌশল তিনি ভালোভাবে জানতেন। ২০০৯ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি পাঁচটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় জড়িত। গত বছর তিনি নাম লেখান রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়।
এদিকে র্যাব নুরুল ইসলামকে টেকনাফ বন্দরের চুক্তিভিত্তিক কম্পিউটার অপারেটর বলে দাবি করলেও স্থানীয়রা বলেছেন নুরুল ইসলাম ছিলেন টেকনাফ স্থলবন্দর শুল্ক অফিসের চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী। দীর্ঘদিন তিনি ঢাকায় থেকে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। মাসে দু-একবার করে টেকনাফে গিয়ে সিন্ডিকেটের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর তিন আত্মীয় এখন বন্দরের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০১ সালে তিনি জীবিকার সন্ধানে টেকনাফে যান। সে বছরই সেখানকার বন্দরের কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে ২০০৩ সালে টেকনাফ সদর উপজেলায় স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ে করেন। এর পর থেকেই মূলত শুল্ক অফিসকেন্দ্রিক দালাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। অভিযোগ আছে, শুল্ক কর্মকর্তাদের সুবিধা দিয়েই দীর্ঘদিন ধরে সেখানে এসব অনিয়ম করেছেন নুরুল ইসলাম।
জানতে চাইলে টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা মো. আব্দুর নুর আজকের পত্রিকাকে বলেন, তিনি পাঁচ মাস ধরে এখানে কাজ করেন। এ সময়কালে সেখানে নুরুল ইসলাম নামের কাউকে দেখেননি। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, স্থলবন্দরকেন্দ্রিক এমন অনেক সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা রাতারাতি বড়লোক হয়ে গেছে। তবে তাঁর দাবি, কোনো সরকারি কর্মকর্তা এসবের সঙ্গে জড়িত নেই।