মন্ত্রী পৌঁছাতে দেরি করছেন, সে কারণে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেমে থাকেনি। প্রথমে ভাবা হয়েছিল আসুন না মন্ত্রী, তারপর শুরু করা যাবে। কিন্তু তাতে ছবিটি দেখার কৌতূহল নিয়ে যাঁরা উপস্থিত হয়েছিলেন মহাখালীর এসকেএস টাওয়ারের স্টার সিনেপ্লেক্সে, তাঁদের ধৈর্যসীমায় আঘাত লাগতে পারে ভেবে সিনেমার লোকেরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন। মন্ত্রী থাকলেন পথে, শুরু হয়ে গেল পরিচিতি অনুষ্ঠান। সিনেমাতেই রয়েছে যে ইংরেজি গানটি, সেটি নাসিম আলী খান পরিবেশন করলেন সবার আগে। মিলনায়তনের প্রায় নিবে যাওয়া রহস্যময় আলো-আঁধারিতে কানে বাজতে লাগল নাসিম আলী খানের গান।
‘জে কে ১৯৭১’ ছবির পরিচালক ফাখরুল আরেফীন খান পরিচয় করিয়ে দিলেন কলাকুশলীদের সঙ্গে। তাঁদের কেউ কেউ যখন কথা বলছেন, তখন উপস্থিত হলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বুঝলেন, সময়ক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষ করে সিনেমাটি দেখার সুযোগ করে দিলেন। ফলে ট্রেন চলল কু ঝিকঝিক। ছবি শুরু হতে দেরি হলো না।
ফাখরুলের যে বিষয়টি আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তা হলো পরিমিতিবোধ। অযথা সংলাপের বাড়াবাড়ি কিংবা দৃশ্যায়নে নাটকীয়তা সৃষ্টির কোনো প্রয়াস দেখি না ওর মধ্যে। যা সাবলীল, যা চোখ এবং কানকে আরাম দেয় কিংবা কষ্ট দেয়, সে রকম ঘটনারই প্রকাশ দেখা গেল ছবিটায়।
আর হ্যাঁ, একটি প্রবল গণযুদ্ধকে শুধু জেনারেলদের সমরকাহিনি বলে চালালেও বিপদ আছে। তাহলে সত্য ইতিহাসটি ভুল দিকে রওনা করতে পারে। ইতিহাসকে ঠিক পথে রাখার জন্য যে প্রয়াসগুলো নিতে হয়, তা নিতে হয় বুঝেশুনেই। আমাদের দেশে একাত্তর নিয়ে যে এখনো বড় মাপের কোনো কাজ হলো না, তার একটা কারণ তো একাত্তরকে ঠিকভাবে বুকে ধারণ করতে না পারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যে সিনেমাগুলো হয়েছে, সেগুলোর দিকে চোখ রাখলেও এই সত্য ধরা পড়ে। যুদ্ধ আছে ছবিতে, কিন্তু মানুষের কাহিনিই সেখানে বিবৃত হয়েছে যথার্থভাবে। ‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’ কিংবা ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’ ছবি দুটির দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়, যুদ্ধের ভয়াবহতা অগ্রাহ্য করে কীভাবে জয়ী হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
ফাখরুল ছবিতে নাটকীয়তা বর্জন করেছেন। আবহ সংগীত ব্যবহারেও ছিলেন সংযত। কখনো কখনো মনে হচ্ছিল একটু নাটকীয় হলে ক্ষতি কী ছিল? হলিউডি ছবির মতো হঠাৎ করে সৃষ্টিছাড়া শব্দের জন্ম হলেই বা কী ক্ষতি ছিল? ছুরি হাতে এয়ারহোস্টেজ যখন জেকেকে হত্যা করার জন্য এগিয়ে আসে, তখন অভিনয়ে কিংবা আবহসংগীতে কি আরেকটু চাঞ্চল্য আনা যেত? কিংবা শেষ দিকে কমান্ডোরা যখন ঢুকছে, তখন কি আরেকটু টানটান হতে পারত দৃশ্যটি? তা নিয়ে বোদ্ধামহলে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু আমরা যারা খোলা মন নিয়ে ছবি দেখতে যাই, যারা সমালোচনা করার যোগ্য নই, তারা ওই সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে রাজি থাকি।
ছবিটি কেবল সিনেমা হলে এসেছে, এখন কাহিনি নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। তাতে দর্শক-শ্রোতা কাহিনি জেনে নেওয়ায় হলে গিয়ে ছবি দেখতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। তাই অন্য কথা বলি। ফাখরুল যখন থেকে ছবি করছেন, তখন থেকেই তাঁর ভাবনার দিকটি স্বচ্ছ ছিল। সে লালনের আখড়া হোক, আর হোক আলবদরের কাহিনি, সে ভুবনমাঝি হোক, আর জেকে ১৯৭১ হোক, সবখানেই ওর বলার উদ্দেশ্যটি পরিষ্কার। আরেফীনের ছবিগুলোয় একধরনের শিকড়ের প্রতি ভালোবাসা দৃশ্যমান। কিংবা একটু ভিন্নধারায় যে ‘গণ্ডি’ ছবিটি তিনি করেছেন, তাতেও প্রকাশ পায় তাঁর পরিমিতি।
অভিনয়ে সবাই উতরে গেছেন। তবে যে ফরাসিরা হাইজ্যাকের মতো একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামাল দিচ্ছিলেন, তাঁদের দেহভাষায় আরেকটু উত্তাপ থাকতে পারত। আর জেকে যখন ফরাসিতে দীর্ঘ দীর্ঘ কথা বলছিলেন, তখন দোভাষী ভদ্রলোক (ইন্দ্রজিৎ যে ভূমিকায় অভিনয় করেছেন) একেবারে মুখস্থের মতো তা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন, সেটা একটু অস্বস্তি আনছিল মনে। বাক্যগুলো আলাদা আলাদা বলা হলে তা মনে রেখে অনুবাদ করা যায়। কিন্তু একবারে বলা কথাগুলো একেবারে ঠিক ঠিক অনুবাদ করা দুরূহ!
বলতে হবে, ফাখরুলের এই সিনেমা স্বস্তি এনে দেয় মনে, আরাম এনে দেয়। বহু দূরদেশের একজন তরুণ তেপান্তরের মাঠ পেরোনো আর এক দেশের শিশুদের বাঁচাতে খালি হাতে প্লেন হাইজ্যাক করছেন, এই অসামান্য ঘটনাটি সংরক্ষণ করা হলো, এ বড় আনন্দ সংবাদ।
ছবিতে ‘জঁ কুয়ে’র ভূমিকায় যে ছেলেটি অভিনয় করেছেন, তিনি নিজেকে ফরাসি যুবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। হ্যাঁ, সৌরভ শুভ্র দাশকে জঁ কুয়ে ভাবতে একেবারেই কষ্ট হয়নি।
শেষ দৃশ্যটি মনে কেন আরাম দেয় সেটা বুঝতে হলে তো যেতে হবে সিনেমা হলে। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা।