‘নেটওয়ার্কের বাইরে’ ওয়েব ফিল্মে কাজ শুরুর আগের অধ্যায়টি কেমন ছিল?
ফোন করে আমাকে জানানো হয়, এমন একটা গল্প তাঁরা ভাবছেন। গল্পটা চার বন্ধুকে নিয়ে। প্রথমে আমি কনভিন্সড ছিলাম না গল্পটা নিয়ে। কারন গল্পে আমার উপস্থিতি কতটুকু, গুরুত্ব কতটুকু—এগুলো নিয়ে চিন্তা ছিল। পরে আমাদের সবাইকে কল করা হয় স্ক্রিপ্ট রিডিংয়ের দিন। সমস্ত কাস্টিং, ক্রুদের নিয়ে রিডিংটা হয়। ওইদিন স্ক্রিপ্টটা পড়া হয় ডিটেইলে। পুরো গল্পটা পড়ে কাজ করতে রাজি হই।
এ ওয়েব ফিল্মের যিনি নির্মাতা, মিজানুর রহমান আরিয়ান, তাঁর কাজে সাধারণত এমন অভিনয়শিল্পীদেরকে দেখা যায়, ইউটিউবে যাদের অনেক ভিউ। এক্ষেত্রে তো আপনি ব্যতিক্রম। বছরজুড়ে খানিকটা আলাদা ধরনের কাজেই আপনাকে পাওয়া যায়। শুধু গল্পটা শুনে ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’ ওয়েব ফিল্মে কাজ করতে রাজি হলেন? নাকি নিজের কাজের ধরণ বদলের চেষ্টা?
আরিয়ানের কাজে অনেক ভিউ হয়, এবং তাঁর আলাদা দর্শক আছে। এদের সঙ্গে যেহেতু আমি নিয়মিত কাজ করি না, সেহেতু এ রকম একটা কাজ করার মানে হচ্ছে নিশ্চয়ই আমি আলাদা কিছু করছি। পুণরাবৃত্তি হয়নি আমার কাজে। তো আপনার প্রশ্নের মধ্যেই কিন্তু উত্তর লুকিয়ে আছে, যে আপনি কখনো এরকম কাজ করেন না। আপনার প্লট ডিফরেন্ট। ওটিটিতে আপনি অন্যমাত্রার কাজ করেন।
যেহেতু আমি অন্য কাজ করি, এবং প্রত্যেকটা কাজ থেকে প্রত্যেকটা কাজ আলাদা করার চেষ্টা করি। তার মানে এটাও একটা আলাদা প্যাটার্ন। আমি কিন্তু কখনো বলিনি, এর কাজ করবো, তার কাজ করবো না। বা এ ধরনের গল্প করব, অন্য ধরনের গল্প করব না।
যদি এই ফ্যাক্টগুলোকে মাথায় রাখতে হয়, তাহলে আমি চেষ্টা করি যে পুরনো ফ্যাক্টের সঙ্গে নতুন ফ্যাক্টগুলো যাতে না মেলে। কিছুটা আলাদা থাকে। যার কারণে হয়তো মনে হবে না, একই জিনিস বারবার করছি। যেটা আমার জন্য অনেক মনোটোনাস।
অডিয়েন্সের কথাও না। আমার ডিরেক্টর টিমের কথাও না। আমি নিজেই একই জিনিসের পুণরাবৃত্তি পছন্দ করি না। ওই জায়গা থেকেই ধরেন, আমি কাজের ইনডিভিজুয়ালিটি মেইনটেইন করার চেষ্টা করি। আরেকটা তথ্য হয়তো আপনি জানেন না। এ নির্মাতার সঙ্গে এটাই আমার প্রথম কাজ নয়।
এর আগেও আপনি আরিয়ানের নাটকে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সেটা তো বেশ আগে। শুরুর দিকে।
আরিয়ানের জীবনের প্রথম প্রডাকশন আমাকে নিয়ে করা। ‘আমি তুমি এবং সে’। তো আফটার নাইন ইয়ারস, ওর জীবনের প্রথম সিনেমাটাও আমাকে নিয়ে করা। আরিয়ানের সাথে আমার বন্ডিং অনেক ডিফরেন্ট। মানে যখন আরিয়ান আসলে আরিয়ান না, তখন থেকে আরিয়ানকে আমি চিনি এবং তাঁর কাজ সম্পর্কে আমি অবগত।
এ সিনেমা করতে আসার সময় আরিয়ান আর আমার একটা অদ্ভুত ইমোশনাল ব্যাপার ছিল। বলছিল, ‘আপু তোমাকে দিয়েই ইন্ডাস্ট্রিতে আমি প্রথম কাজ করেছি।’ ওই গল্পে বোধহয় কাস্টিং ছিল আমি, ঈশানা, আরিফিন শুভ। শুভর ওটা শেষের দিকের কাজ সিনেমাতে ঢোকার আগে।
তারপর বললো যে, ‘আজকে নয় বছর পরে তোমার সাথে আবার আমার প্রথম সিনেমাতে কাজ হচ্ছে। সো আমি এক্সাইটেড এবং ইমোশনাল।’ আসলে বাইরে থেকে যা দেখতে, পেছনের গল্প অনেক আলাদা থাকে। আপনারা যেটা প্রেডিক্ট করেন, আমাদের রিলেশনের ব্যাপারটা বা আমাদের কাজের কেমিস্ট্রিটা তার উর্দ্ধে।
আমি আবার এই জায়গা থেকে লাকি। আমার বন্ধু অনেক বেশি না। আমার যারা বন্ধু, তাঁদের সাথে এখনো আমার যোগাযোগ আছে। তাঁদের সাথে ঘোরাফেরা, দেখা-সাক্ষাৎ সবকিছুই হয়। আমি তো খুবই চুপচাপ নিজের মতো লাইফ লিড করতে পছন্দ করি। এবং প্রাইভেসি পছন্দ করি। ফলে স্বাভাবিকভাবে ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গেই আমার বেশি সময় পার করা হয়, যখন আমার কাজ থাকে না। এখনও আমার স্কুলের বন্ধু, আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু এবং কাজের ক্ষেত্রে অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে এরকমও আমার বেশকিছু বন্ধু আছে, যাদের সাথে দশ বছর, বারো বছর, পনেরো বছরের সম্পর্ক। তাদের সাথে এখনও কমিউনিকেশন হয়। সো ফ্রেন্ডশিপটা আমার কাছে খুবই আলাদা জায়গা রাখে।
‘নেটওয়ার্কের বাইরে’ ওয়েব ফিল্মে একটা সংলাপ আছে আপনার চরিত্র ডাক্তার তানিয়ার মুখে— ‘এক রাতের বাস জার্নিতে প্রেম হয় না, যেটা হয় সেটা হচ্ছে ইনফ্যাচুয়েশন’। আপনি নিজে কী বিশ্বাস করেন? সম্পর্ক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সময়টা ফ্যাক্ট নাকি পরিবেশ-পরিস্থিতি?
সম্পর্কের ক্ষেত্রে সময় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সময় আসলে সম্পর্কগুলোকে বুঝতে শেখায়। নিজের ভুল, আবার নিজেদের ভালো-মন্দ এসব বিষয় সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করতে শেখায় সময়। আবার কিছু কিছু বন্ডিংও থাকে, যেখানে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়ে না। অল্প দু-একটা স্পার্কলিং, বন্ডিং, টিউনিং মিলে গেলে একটা ছোট জার্নি পার করে দেওয়া যায়।
আমাদের যেমন হয়, ডেইলি আমাদের নতুন নতুন চেহারার সাথে ডিল করতে হয়। আজকে প্রোডাকশনের যে ছেলেটাকে দেখছি, কালকে দেখছি আরেকটা নতুন ছেলে। কিন্তু ও আমাকে পাঁচবেলাই পাঁচ কাপ চা দিয়ে যাচ্ছে। ও আমাকে দু-বেলার খাবার এনশিওর করছে। ওর সাথে আমার একটা আলাদা পরিচিতির জায়গা তৈরি হচ্ছে। আমি ওর নাম জানার চেষ্টা করছি, কদ্দিন ধরে কাজ করে, কীভাবে এল— এ রকম কনভারসেশন আমার হয়। আমি জানি না, অন্য আর্টিস্টদের হয় কিনা! কিন্তু আমি এটা মেইনটেইন করি। দেখা যায় যে, ওইটুকুই, দুইদিনের শুটিংয়ের ওই পরিচিতিটুকুই, নেক্সট কোনো শুটিংয়ে দেখা হলে ঠিক ওই জায়গা থেকেই গল্পটা আবার শুরু হয়।
আপনি নীরবে কাজ করায় বিশ্বাসী। সবসময় বলেন ‘প্রকাশিত হওয়া আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়’। সোশ্যাল মিডিয়ার ইদানীংকার আলোচনা-প্রশংসা কি আপনার জীবনযাপনে প্রভাব ফেলছে?
না। কারণ আমি কোনোকিছুকে পার্মানেন্টলি ধরি না। যা হচ্ছে, সেটা ঘটনার একটা বহমান ধারা। আমি যেভাবে কাজ করি, সেভাবেই কাজ করে যাব। আমি বিশ্বাস করি, কোনো প্রতিভাকে রেটিং দিয়ে মাপা যায় না। কারণ প্রত্যেকটা গুণাগুনেরই নিজস্বতা থাকে। দেখা যাচ্ছে, আজকে যে কোথাও খুব খারাপ করছে, আগামী দু-বছর পরে সে যে দুর্দান্ত কিছু ঘটিয়ে ফেলবে না— তার কোনো গ্যারান্টি নেই। আমি কেন প্রচারে বিশ্বাস করি না, কারন আমি শিখতে ভালোবাসি।
অভিনয়ে প্রায় একযুগ কাটিয়ে দিলেন। কখনো আপনাকে নিয়ে কোনোরকম আলোচনা হয়নি, আবার কখনো তুমুল বিতর্কের কবলেও পড়েছেন। কীভাবে দেখেন এই জার্নিকে?
এমনও সময় গেছে, আমাকে নিয়ে মানুষ কোনো আলোচনাই করেনি। অনেক প্রডাকশন গেছে, যে প্রডাকশনে আমিও কাজ করেছি। কিন্তু সব আলোচনা হয়েছে আমার সহশিল্পীকে নিয়ে। তাতে মনে হয়েছে, আমি ইনভিজিবল, আমি কোথাও নেই। আবার এমনও তো ঘটেছে, যেখানে মানুষ আমাকে নির্দিষ্ট একটা কাজ দিয়ে জাজমেন্ট করে, খুবই অশ্রাব্য গালিগালাজও করেছে। সুতরাং এই আলোচনা কিংবা সমালোচনায় কিছু আসে যায় না। কারন আমি জানি, কর্মই আমাকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবে।
সাক্ষাৎকার: খায়রুল বাসার নির্ঝর