মানুষের সঙ্গে সংগীতের সম্পর্ক যেমন হৃদয়ের, তেমনি প্রকৃতির সঙ্গে সংগীতের সম্পর্কও নিবিড়। এই যে জলে নৌকার বয়ে চলার শব্দ; এই বয়ে চলার মধ্যে রয়েছে সংগীতের সুর, তাল ও লয়। প্রকৃতির কাছে মনকে সঁপে দিলে খুঁজে পাওয়া যাবে সংগীতের মায়ার খেলা।
নদীমাতৃক এই দেশে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, মুর্শিদি, জারি, সারি গান হলো সংস্কৃতির অংশ। এই গানে রয়েছে গ্রামবাংলার কথা। এমন একসময় ছিল, যখন এলাকাভেদে গ্রামগঞ্জে শোনা যেত এই গান।
শাহ আবদুল করিমের ‘গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু-মুসলমান’ গানের একটি অংশ হলো–
‘হিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইতো
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
জারি গান, বাউল গান
আনন্দের তুফান
গাইয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম’…
সারি গান হলো সারিবদ্ধ গান। নৌকার ওপরের গান। এই গান এককভাবে গাওয়া হয় না। নৌকায় কয়েকজন মিলে এই গান করতে হয়। শ্রাবণ থেকে কার্তিক মাস হলো সারি গানের সময়।
এই সাধক তাঁর বাজানের (বাবা) কাছ থেকে দোতারা, সারিন্দা বাজিয়ে শেখেন গান। সময়টা ছিল ব্রিটিশ আমল। এরপর তিনি পাকিস্তান আমলে আর স্বাধীন বাংলাদেশে গান করেন। ১৫ বছর বয়স থেকে গান লেখা শুরু করেন তিনি। ছোটবেলা থেকে গান তাঁকে অদ্ভুতভাবে কাছে টানত। এ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক গানের ধারায় জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বাউল, মারফতি, কবিগান, মুর্শিদি, গাজির গানসহ অনেক গান লিখেছেন।
সাইদুর রহমান বয়াতির একবার ব্যাংকে চাকরি হলো। সে সময় দেশে এল রূপবান গান। তিনি ছিলেন গানের মানুষ। ব্যাংকের হিসাবের খাতায় লিখলেন ‘সাগরপাড়ের নাইয়া’ গানের কয়েকটা লাইন। সে কারণে চাকরি হারান তিনি।
দীর্ঘসময় ধরে সারি গান করছেন সাইদুর রহমান বয়াতি। তিনি বলেন, ‘সারি গানের মর্মকথা হলো এই যে আমাদের দেহ, এটা হলো একটা নৌকা। আর যে কাঠের নৌকায় আমরা উঠি, তা হলো মানবতরি। পানিকে বলা হয় মা গঙ্গা। সেই গঙ্গাতে নৌকা ছেড়ে দেওয়া হয়। এ জন্য সারি গানের শুরুতে বলা হয় ‘মা গঙ্গির নামে কইরা সার, নৌকা ধরি ভব পার দেয়, নৌকা ছাড়িল ছাড়িল রে’। সারি গান একেক এলাকায় একেক সুরের হয়। তবে মানিকগঞ্জের সারি গানের সঙ্গে ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকার সারি গানের কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
‘সারি গানের নৌকার নাম খান্জী নৌকা। এখন আর এই নৌকা দেখা যায় না। এই নৌকা মালিকের ঘাট থেকে মেলা বা বাজারের উদ্দেশে ছাড়ার আগে আমার কমপক্ষে ছয়জন মানুষের সারি দেওয়া লাগব। সামনের দুজন গায়ক। তাঁদের মধ্যে প্রধান একজন থাকেন। যেমন আমি। আর দোহার লাগব আরও চারজন। সারি গানে বাদ্যযন্ত্র থাকে বামা আর খঞ্জনি। আর কোনো বাদ্যযন্ত্র লাগে না। প্রথম যে গানটা আমাকে ওঠাতে হয়, সেটা হলো, “সাজাইয়া দেও মা তোমার গোপালরে। তোমার গোপাল যদি না যায় গোষ্ঠে, আমরা যাব না। গোপাল সাজাই দাও মা”।
‘এটা প্রথম গান। এই গান গাইলে পরে নৌকা ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন আমরা আবার গাইব “একা আসলা বড় নগরীতে, মাগো ভাগ্যবতী। একা আসলা বড় নগরীতে।” এরপর নৌকা কিছু দূর গেলে গাইব “নৌকা ছাড়িল, ছাড়িল রে। সোনার তরণি রণে ছাড়িল রে”। আরও কিছু দূর গেলে গাইব “উজান ছাড়িল, ছাড়িল রে। খোপের কবুতরগুইলা ছাড়িল ছাড়িল রে”। এভাবে নৌকা চলতে থাকল। তারপর আরও দূরে গেলে গাইব “যাও তোমরা কানাই ডিঙা বাইয়া, সাত বন্ধুরে। যাও তোমরা কানাই ডিঙা বাইয়া”। এভাবে সারিবদ্ধভাবে সারি গান চলতে থাকে। এরপর নৌকা যখন মেলা বা বাজারে গিয়ে পৌঁছায়, তখন “সাম্পান আইসাছে কদমতলে, ও ললিতে। সাম্পান আইসাছে কদমতলে। কীসে আমার রান্ধাবাড়া, কিসের হলুদ বাটা। আরে দুই নয়নের জলে আমার ভাইসা চলে পাতা। ও ললিতে সাম্পান আইসাছে কদমতলে”—এই গান গাইব।
গানের সাধক সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমার কাছে অনেক সারি গান আছে, যা বাংলাদেশে আর কারও কাছে নাই। গান হলো দেশের সংস্কৃতি। সংস্কৃতি যদি হারিয়ে যায়, সে দেশের অঙ্গহানি হয়। বর্তমান সরকারের উচিত এসব গানের রক্ষণাবেক্ষণ করা। আমি মনে করি, আমি মরে যাওয়ার পর সারি গান এ দেশে থাকবে না। এখন তেমন কেউ জানেই না, সারি গান কী। ছোট একটা ঘটনা বলি, কোনো এক বছর ঢাকা থেকে ফোন দিল আমারে; নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে গান গাওয়ার জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি সেখানে গিয়ে দেখি এক বয়াতি সারি গান বলে যা শুনাইল, তা সারি গানের মধ্যে পড়ে না। তিনি গাইলেন “নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে”। এগুলো হলো সায়রের গান। আমি বললাম এগুলো সারি গান না। আমি সারি গান গাইতে পারব। তবে তার জন্য আমার কমপক্ষে চারজন লোক মানে দোহার লাগবে। কিন্তু পরে আমাকে আর সেখানে গাইতে দিল না। আমরা আর সারি গান শুনাইতে পারলাম না।’
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা