কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্র সৈকতে এক তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে— এমন দাবিতে একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওটির ক্যাপশনে দাবি করা হচ্ছে, ভিডিওতে থাকা তরুণী পর্যটক ছিলেন। তাঁর গাড়ি থামিয়ে ছিনতাই ও পরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। এরপর মুখে ছুরি দিয়ে আঘাত করে রাস্তায় ফেলে চলে যায় দুর্বৃত্তরা।
‘মহেশখালী নতুন বার্তা’ নামের ফেসবুক পেজ থেকে গত শনিবার (২৫ জানুয়ারি) রাত ১১টার দিকে এই দাবিতে পোস্টটি করা হয়। পোস্টে ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘টেকনাফ সমুদ্র সৈকতে এক তরুণী কে গন ধর্ষন একটি ফেইসবুক পোস্ট জানা যায় উনি টুরিস্ট ছিলেন, গাড়ি থামিয়ে ছিনতাই করে পরে গণধর্ষন এর পর ওর মুখে চুরি আঘাট করা হয়। এর পর রাস্তায় এভাবে ফেলে চলে যায়। আমরা কোন দেশে বসবাস করছি, এসব দেখতে দেখতে আমরা কি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। ঐ সব জারজ সন্তানদের কি মা-বোন নেই। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা কি আদো ঠিক হবে না...! আল্লাহ আমাদের সকল মা-বোনদের হেফাজত করুন। আমিন।’ (বানান অপরিবর্তিত)
একই ভিডিও দেশের অন্য একাধিক জেলার ঘটনা দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আছে— মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলা।
এ ছাড়া স্থানের নাম উল্লেখ না করেও একাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছে। বেশিরভাগ পোস্টের ক্যাপশনে লেখা, ‘আইয়্যেমে জাহেলিয়া যুগকে হার মানিয়েছে, দিনের শুরুটাই হয় এখন লা*শ দিয়ে আর শেষটা হয় ধ*র্ষ*ণ দিয়ে।’ (বানান অপরিবর্তিত)
একই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়া এক্স– এও ছড়িয়েছে।
এসব পোস্টের মধ্যে মেহেদী হাসান নামে (Mehedi Hasan) নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে গত শনিবার রাত ৯টার দিকে পোস্ট করা ভিডিওটি বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। এই অ্যাকাউন্টটির অ্যাবাউট সেকশনে নিষিদ্ধ সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্য বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত ওই ভিডিওটি প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজারবার দেখা হয়েছে এবং পোস্টটি শেয়ার হয়েছে ৪৭৮। এতে কমেন্ট পড়েছে ২৪১টি। এসব কমেন্টে অনেকে ভিডিওটি ভারতের উল্লেখ করেছেন। আবার অনেকে বাংলাদেশের ভেবে মন্তব্য করেছেন। মো. ইয়ামিন ইয়ামিন ভূঁইয়া (Md Eamin Eamin Bhuyen) নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে লেখা হয়েছে, ‘এই গুলো কিছু না আমাদের এই দেশ সব কিছু সম্ভব।’ (বানান অপরিবর্তিত)
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ইট বিছানো রাস্তার মাঝখানে একজন তরুণী রক্তাক্ত অবস্থায় দুই পা ভাঁজ করে বসে আছেন। চারপাশ অন্ধকার, শুধু তরুণীর গায়ের ওপর আলো পড়েছে।
ভিডিওটিতে অনেক মানুষকে কথা বলতে শোনা যায়। তাঁরা বাংলায় কথা বলছেন। তরুণীটি কথা বলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু খুবই অস্পষ্ট। একজন তরুণীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার বাড়ি কোথায়?’ তরুণীটির কথা এতোটাই জড়িয়ে যাচ্ছে যে জবাবটি বোঝা যায়নি। তবে পাশ থেকে আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘মুন্সিপাড়া?’
এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ভিডিও দেখে রক্তাক্ত তরুণীকে নিজের মেয়ে দাবি করেছেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার কাউলিবেড়া ইউনিয়নের পশ্চিম কাউলিবেড়া গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী তারা মিয়া। গত মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) কাউকে না বলে মেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় বলে জানান তিনি। এর থেকে তারা মিয়ার কিশোরী মেয়ে নিখোঁজ। গত বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) তিনি ভাঙ্গা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। এ বিষয়ে আজকের পত্রিকায় আজকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
ভিডিওটির কিছু কি–ফ্রেম নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হলে শাহ পরান (shahaporan) নামে একটি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা একই ভিডিও পাওয়া যায়। পোস্টটি গত ২৪ জানুয়ারি পোস্ট করা হয়। ভাইরাল ভিডিও সংক্রান্ত সম্ভাব্য প্রথম পোস্ট এটি।
ক্যাপশনে ইংরেজিতে লেখা, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে এই নারীর এমন অবস্থা হয়েছে।
শাহ পরান (shahaporan) নামে ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টটির অ্যাবাউট সেকশনের তথ্য অনুযায়ী, এটি ভারত থেকে পরিচালিত হয়।
ওপরে উল্লেখিত কোনো পোস্টেই তথ্যের সূত্র উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি ওই তরুণীর পরিচয়ও উল্লেখ করা হয়নি।
এসব তথ্যসূত্রে গুগলে সার্চ করে ‘Vision 18 বাংলা’ নামে একটি ফেসবুক পেজে গত ২৪ জানুয়ারি পোস্ট করা একটি ভিডিও প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে দেখানো হয়, মাঠের মাঝ দিয়ে যাওয়ার ইট বিছানো একটি রাস্তার পাশে ক্রাইম সিন ঘিরে রাখছে পুলিশ। সেখান থেকে পুলিশকে আলামত সংগ্রহ করতেও দেখা যায়। অদূরে উৎসুক জনতা। ভিডিও প্রতিবেদনটির ৩ মিনিট থেকে শুরু করে ৩ মিনিট ৫০ সেকেন্ড পর্যন্ত একটি ফুটেজ জুড়ে দেওয়া হয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, অন্ধকারে ইট বিছানো রাস্তার ওপর এক নারী রক্তাক্ত অবস্থায় কাত হয়ে শুয়ে আছেন। সামান্য নড়ানড়া করছেন। মুখের অংশটি ব্লার করা। নারীর পোশাকের সঙ্গে ভাইরাল ভিডিওটির তরুণীর পোশাকের মিল রয়েছে।
ক্যাপশন থেকে জানা যায়, ঘটনাস্থল ভারতের পশিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর বিধানসভা আসনের বকুলতলা পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন নিমপিঠ। গত মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) দিবাগত গভীর রাতে মায়াহউরি পঞ্চায়েতের আনন্দপুর রথতলা এলাকায় ইটের রাস্তায় একজন টোটো চালক (অটোরিকশা চালক) এই নারীকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজনকে ডাকেন। এরপর পুলিশকে খবর দিলে তারা নারীকে নিমপীঠ গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক নারীকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, নারীর শরীরে অস্ত্রের কোপ ছিল। বিশেষ করে মুখের এক দিক থেঁতলানো। বেশ কয়েকটি দাঁত ভাঙা। জখম থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ তাঁর পরিচয় জানার চেষ্টা করছে।
এসব তথ্যসূত্রে সার্চ করে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম জি২৪ঘণ্টায় ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটিতে ‘Vision 18 বাংলা’ নামে ফেসবুক পেজের ওই ভিডিও প্রতিবেদন ও ক্যাপশনে উল্লেখিত একই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া একই তথ্যে নিউজ ১৮, ইটিভি ভারত, সংবাদ প্রতিদিনসহ একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কোনো প্রতিবেদনেই ওই নারীর পরিচয় উল্লেখ নেই।
সুতরাং, টেকনাফ সমুদ্র সৈকতে তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের দাবিতে বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি প্রকৃতপক্ষে, ভারতের পশিমবঙ্গ রাজ্যের জয়নগরের বকুলতলা থানা এলাকার।